বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে ভারতের মাথা ব্যাথা কেন?

বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে ভারতের মাথা ব্যাথা কেন?

গত কয়েকদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশকে নিয়ে বাঁকা দৃষ্টির লেখা প্রকাশ করছে। তাদের প্রকাশিত লেখাগুলো পড়ে একটি বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় আর সেটি হলো- বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্কের কারণে ভারত খুবই বিচলিত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে ভারতের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।



বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্ক উন্নতি হলে ভারতের সমস্যা কোথায়? কেন'ই বা ভারত "বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্ক"কে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখছে? চলুন জেনে নিই, বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের উন্নতি হলে কেন সেটি ভারতের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ব্লগে যা যা থাকছে-
  • বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতি
  • বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কে টানাপোড়েন যে কারণে
  • বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্কে ভারতের মাথা ব্যাথার কারণ
  • বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্কের ভবিষ্যত


বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতি

বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক গলায় গলায় ভাবের না হলেও গত কয়েক বছরে দু'দেশের সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি দেখা গেছে৷ বিশেষ করে, পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর থেকে সম্পর্কে কিছুটা উষ্ণতা লক্ষ্য করা গেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক তেমন একটা ভালো কখনোই ছিল না। বিএনপির আমলে কিছুটা উন্নতি হলেও আওয়ামীলীগের আমলে ন্যুনতম পর্যায়ে ঠেকে ছিল। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নতি না হওয়ার পেছনে মূলতঃ কয়েকটি বিষয়কে দায়ি করা যায়। যেমন-

  • যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাকিস্তানের নাক গলানো: স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করলে পাকিস্তান এই বিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। এমনকি যুদ্ধপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামীদের পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলতে থাকে। আব্দুল কাদের মোল্লার ফাসীর পর পাকিস্তান সংসদে শোক প্রস্তাবও আনে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোকে ভালোভাবে নেয়নি বাংলাদেশ সরকার। ফলস্বরূপ পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল ২০১৪ সালের দিকে।

  • বাংলাদেশের উন্নতির বিরুদ্ধাচারণ: বাংলাদেশের উন্নতিকে বরাবরই পাকিস্তান বিরুপ দৃষ্টিতে দেখেছে। পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ এমনকি জনসাধারণও বাংলাদেশের উন্নতিকে ভালো চোখে দেখেনি। নেতিবাচক ধ্যানধারণা থেকে বাংলাদেশকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কারণে পাকিস্তান বাংলাদেশ সম্পর্ক কখনোই উন্নতির মুখ দেখেনি।

  • মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস গোপন রাখা: পাকিস্তানের পাঠ্যবই এ এখনো ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের কূটনীতি হিসেবে ব্যাখ্যা করে। পাকিস্তান বরাবরই বলতে চেয়েছে- ৭১সালে যে যুদ্ধ হয়েছে সেটির জন্য ভারত দায়ী৷ ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যার দায় এখনো পাকিস্তান স্বীকার করেনি।

সর্বশেষ, ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানে বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তাধারার কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি পাকিস্তান থেকে শক্তিশালী হওয়ায় বর্তমানে সেদেশের রাজনৈতিক ব্যাক্তি থেকে শুরু করে অর্থনীতিবিদ সবাই একবাক্যে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করছে।

ইন্টারনেটের বদৌলতে সেদেশের জনগণও জেনে গেছে, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস কি ছিল। তাছাড়া ইমরান খান বা সেদেশের বুদ্ধিজীবিরা প্রকাশ্যে বিভিন্ন মিডিয়াতে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোকে তারা এড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কিছুটা উন্নতি দেখছে।


বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক তলানিতে যে কারণে

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক সবসময় উষ্ণ ছিল। মাঝখানে সামরিক শাসন যতদিন ছিল ততদিন এই দু'দেশের সম্পর্ক তেমন আহামরি ছিলনা কিন্তু ১৯৯১ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যবর্তী সম্পর্ক উষ্ণ হতে থাকে। ২০০৮ সালে হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সর্বোচ্চ উষ্ণতায় রয়েছে বলে ধারণা করা হলেও বর্তমানে সেটিতে ফাটল ধরেছে বলেই মনে হয়। ভারত বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের এই অবনতি কেন? এক্ষেত্রে আমরা কয়েকটি বিষয়কে সামনে আনা যায়-

  • তিস্তা চুক্তি না হওয়া: ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামীলীগ বেশ কয়েকবার তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন করার জন্য ভারত সরকারকে তাগিদ দেয়৷ কংগ্রেসের আমল থেকে শুরু করে বিজেপি প্রত্যেক সরকারের আমলেই তিস্তা চুক্তিটি সম্পন্ন করতে চেয়েছে আওয়ামীলীগ কিন্তু প্রতিবারই ভারত অনাগ্রহ দেখিয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করলেও ভারত তিস্তা চুক্তির মতো ইস্যুকেও এড়িয়ে গেছে।

  • এনআরসি ও সিএএ নিয়ে বাংলাদেশের অসন্তোষ: ভারতের বিতর্কিত  নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে বিতর্ক আছে। পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে বিতর্কিত আইনটি নিয়ে মাথাব্যাথার কারণ আছে বাংলাদেশেরও। ভারত বারবার এনআরসি বা সিএএ'কে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বললেও সেদেশের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন তীর্যক মন্তব্য বাংলাদেশকে ভাবিয়ে তুলেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত এনআরসি প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

  • ভারতের জাতীয়তাবাদকে ভালো চোখে নেয়নি বাংলাদেশ: ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতে জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। মোদী সরকার সেই জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করেই মূলতঃ রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই সাথে উগ্র হিন্দুত্ববাদের কারণেও ভারতে মুসলিমরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে যার উদাহরণ বাবরি মসজিদ, কাশ্মিরের মত বিতর্কিত ইস্যু। মুসলিম প্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মৌখিকভাবে স্বীকার না করলেও বস্তুত এই ইস্যুগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ।

এরকম আরও বহু কারণ রয়েছে যার জন্য বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক তলানিতে৷ এর মধ্যে সীমান্তে হত্যাকান্ড উল্ল্যেখযোগ্য। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের সোনালী অধ্যায় আওয়ামিলীগ সরকারের আমলেই স্তমিত হওয়ার উপক্রম।


বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্কে ভারতের মাথা ব্যাথার কারণ

একদিকে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের উন্নতি; অপরদিকে বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কে অবনতি দু'টো মিলে ভারত অনেকটাই বিচলিত। পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্ক সবসময় বৈরি থাকায় "বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্ক"কে সহজে হজম করতে পারছে না ভারত৷ বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্কে ভারতের বিচলিত হওয়ার কারণ খুবই স্বাভাবিক। চলুন জেনে নেয়া যাক, "বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্ক" নিয়ে ভারতের মাথা ব্যাথা কেন তার কয়েকটি কারণ-

বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন প্রতিবেশি ভারতের পক্ষে নেই

কয়েক বছর পূর্বেও নেপালকে ভারতের একটি রাজ্য মনে হতো। বর্তমানে নেপালের সাথে ভারতের সম্পর্ক সাপে নেউলে। শ্রীলংকার সাথে ভারতের সম্পর্ক অনেক আগেই শেষ হয়েছে। পাকিস্তানের সাথে তো কোনদিন সম্পর্ক ছিলই না ভারতের। চীনের সাথেও ভারতের সম্পর্ক যুদ্ধাবহের বেষ্টনীতে আটকা। অন্যদিকে মিয়ানমার চীন ঘেষা। সব মিলিয়ে প্রতিবেশি হিসেবে কেবল বাংলাদেশকেই পাশে পায় ভারত৷ বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতি হলে বাংলাদেশকেও হারানোর শংকায় ভারত। একারণেই মূলতঃ ঢাকাকে নিয়ে মাথা ব্যাথা দিল্লির। 


দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বৃদ্ধির শংকা

ইতোমধ্যে পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারে ঘাটি গেড়েছে চীন। ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের বিপরীতে চীনের পাল্টা আগ্রাসী মনোভাব পরিলক্ষিত যেকারণে দেখা যায় চীন ভারতকে চতুর্দিক থেকেই ঘিরে ফেলেছে। বাংলাদেশকে চীন হাতের মুঠোয় নেওয়ার জন্য কয়েক বছর ধরে চীন চেষ্টা করছে যা ভারতের অজানা নয়। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উষ্ণ হওয়া মানেই যেকোন সময় "পাকিস্তান চীন বাংলাদেশ" এক কাতারে চলে আসবে। তখন চীনের সাথে ভারতের লড়াই করা আর সম্ভব হবেনা।


অর্থনীতি হ্রাসের সম্ভাবনা

প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে বিশাল অংকের অর্থ যায় ভারতে রেমিট্যান্স হিসেবে৷ প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক ভারতীয় বাংলাদেশে চাকরি করে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক অবনতি হলে (তাদের ধারণা, পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়ন মানেই বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক অবনতি) অনেক ভারতীয় চাকরি হারাবে। এছাড়াও বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত ট্রানজিট সুবিধা কিংবা অন্যান্য আরও সুযোগ হারানোর ঝুঁকি থাকায় ঢাকা ইসলামাবাদের সম্পর্কে মাথা ব্যাথা দিল্লির।

পাকিস্তান চীন সীমান্তে সেনা সংকটের আশংকা

এমনিতেই সকল প্রতিবেশির সাথে ভারতের সম্পর্ক ভালো নয় যার ফলে সীমান্তে সেনাবাহিনীর প্রয়োগ বেশি করতে হয় ভারতের। বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক এখন পর্যন্ত ভালো হওয়ায়, বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের সেনাবাহিনীর তেমন প্রয়োজন হয়না। পাকিস্তান বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নতি হলে বাংলাদেশ সীমান্তেও সেনা ছাউনি বানাতে হতে পারে কিন্তু এত বিশাল সংখ্যক সেনা ভারতের নেই।

এছাড়াও আরও নানাবিধ কারণ রয়েছে যার কারণে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক ভারত দেখতে নারাজ। বাংলাদেশ সকল দেশের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী হলেও ভারত সবসময় বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ককে সরল দৃষ্টিতে দেখবে না।


বাংলাদেশ পাকিস্তান সম্পর্কের ভবিষ্যত

যেকোন দু'টি দেশের মধ্যকার সম্পর্ক শীর্ষে যাওয়ার ক্ষেত্রে দু'টি দেশেরই কিছু স্বার্থ থাকতে হয়। বাংলাদেশ পাকিস্তান উভয় দেশই উন্নয়নশীল দেশ। অর্থনৈতিকভাবে কোন দেশই আরেকটি দেশকে আর্থিক অংশীদার বানাতে পারবে না। ভৌগোলিক দিক থেকেও বাংলাদেশ পাকিস্তানের মধ্যকার দূরত্ব ১২০০ মাইল সুতরাং এই দু'টি দেশের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নত হলেও দহরম মহরম হওয়ার মতো কোন কারণ নেই।

তাছাড়া বাংলাদেশে পাকিস্তান বিরোধী একটি শক্তি রয়েছে যা বাংলাদেশকে কখনোই পাকিস্তানের সাথে দেখতে চাইবে না। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের যে উন্নতি দেখা যাচ্ছে সেটি সকল দেশের সাথেই বাংলাদেশের রয়েছে। পাকিস্তানের সাথে আরও আগে এরকম ভালো সম্পর্ক থাকতে পারতো কিন্তু সেটি হয়নি। মূলকথা হচ্ছে, পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে বাংলাদেশের তেমন কোন স্বার্থ নেই- যতটুকু উন্নয়ন হচ্ছে আঞ্চলিক দিক থেকে সেটি হওয়া আবশ্যক৷

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ