লাদাখ সীমান্ত নিয়ে ভারত চীনের মধ্যে দ্বন্ধ বহু পুরোনো। এই দ্বন্ধের জের ধরে প্রায়ই যুদ্ধের দামামা জ্বলে উঠে পার্শ্ববর্তী এই দু দেশের মধ্যে। চীনের সাথে পাকিস্তানের শখ্যতা দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় চীন-ভারত দ্বন্ধের মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে। সামরিক দিক থেকে চীনের সক্ষমতা ভারতের চেয়ে কয়েকগুন শক্তিশালী হলেও একুশ শতকে যুদ্ধের সম্ভাবনা তেমন নাই বললেই চলে; সেক্ষেত্রে সামরিক যুদ্ধে কে জয়ী হবে তা নিয়ে বিতর্কে না যাওয়াই ভালো।
যে প্রশ্নটি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সেটি হলো; শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে কে ভারতের মিত্র আর কে চীনের মিত্র? কেন মাথায় এই প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে তার একটি কারণ হলো- সামরিক যুদ্ধ না হলেও; বানিজ্যযুদ্ধকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। যেকোন সময় বানিজ্যযুদ্ধ শুরু হলে; কার মিত্র কে সেটি হয়ে দাঁড়াবে "তুরুপের তাস"। কোন দেশই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় যেকারণে নির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে চীন, ভারত কে কয়টি দেশকে কাছে পাবে তা নিয়েই যত চুলচেরা বিশ্লেষণ।
রাশিয়ার হাতে "ট্রাম্পকার্ড"
রাশিয়া বর্তমানে কোন দেশের সাথেই গলায় গলায় ভাব করে চলছে না। সিরিয়া সংকটে তুরস্কের সাথে বাদানুবাদ ই প্রমাণ করে; রাশিয়া কারো মিত্র নয় আবার শত্রুও নয়। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই রাশিয়া এই স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আগাচ্ছে। ভারতের সাথে ঐতিহাসিকভাবেই রাশিয়ার সম্পর্ক থাকলেও সেটি ধীরে ধীরে কমে গেছে।
চীনের সাথে রাশিয়ার সম্পর্কটা কখনোই আচ করা যায় না; তবে দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের কোন টানাপোড়েন যে নেই তা প্রায় সবারই জানা। অর্থাৎ চীন-ভারত যুদ্ধে রাশিয়াকে কে পাবে; তা নিয়ে বিশাল মতভেদ আছে। রাশিয়া যে দেশের প্রতি ঝোকবে; এশিয়াতে জয়ী হবে সে ই। এজন্যই রাশিয়াকে বলা হয় "এশিয়ার ট্রাম্প কার্ড"। বর্তমানে ভারতের সাথে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় রাশিয়া তার চিরচারিত অভ্যাসের কারণেই "ভারত চীন যুদ্ধে" চীনের পক্ষাবলম্বন করার সম্ভাবনাই অধিক। আবার চীন ভারত যুদ্ধে রাশিয়া অবস্থান নিরপেক্ষও হতে পারে। কেন নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে পারে রাশিয়া তার দুটি কারণ আছে-
- রাশিয়ার বাণিজ্য নীতি: রাশিয়া সামরিক খাতে প্রাধান্য দেওয়ার চেয়ে অর্থনীতিতে এখন অনেক বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে; ফলে সামরিক যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার তেমন মাথা ব্যাথা দেখা যায় না। চীন ভারত যুদ্ধ হলে, রাশিয়ার অর্থনীতির প্রচুর ক্ষতি হবে যা রাশিয়া কখনোই চাইবে না সুতরাং সামরিক বা বানিজ্য যে যুদ্ধই হোক; রাশিয়া সেটিকে থামিয়ে দেওয়ারই চেষ্টা করবে।
- আন্তর্জাতিক প্রভাব ধরে রাখা: রাশিয়া এমন এক স্ট্র্যাটেজি নিয়ে বর্তমানে অবস্থান করছে যেখানে এক আমেরিকা ছাড়া প্রায় সব দেশের সাথেই রাশিয়ার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। ইরানের সাথে যেমন রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো তেমনি সৌদি আরবের সাথেও সম্পর্ক খারাপ নয়। ইউরোপ, আফ্রিকা কিংবা এশিয়ার কোন দেশের সাথেই রাশিয়ার বাদানুবাদ সম্পর্কে নেই; তবে কিছু গোষ্ঠীর সাথে বৈরিতা থাকলেও সেটির সংখ্যা খুব বেশি নয়। পৃথিবী জুড়ে নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য রাশিয়া সবসময় চুপচাপ নীতি অবলম্বন করে এবং ভবিষ্যতেও করবে।
সবদিক বিবেচনায়, রাশিয়া কোন দিকে হেলছে নাকি নিরপেক্ষ থাকছে তার উপরই চীন ভারত যুদ্ধের ভবিষ্যত নির্ভর করবে। রাশিয়া নিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করলে এশিয়াতে অন্যকোন দেশের নাক গলাতে আসার সম্ভাবনা একেবারেই কম। সুতরাং রাশিয়া কার মিত্র? ভারত নাকি চীনের? সেটি নিয়ে ধোয়াশা কখনোই কাটবেনা। আর একারণেই চীন ভারত দ্বন্দ্বে রাশিয়া ট্রাম্পকার্ড।
আমেরিকা ভারতের "মরণাস্ত্র"
ভারতের মরণাস্ত্র কি? পারমাণবিক বোমা? অবশ্যই নয়। আগেই বলেছি, সামরিক যুদ্ধের সম্ভাবনা খুবই কম। বানিজ্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে আমেরিকা হবে ভারতের মরণাস্ত্র। চীনের সাথে আমেরিকার বাদানুবাদ একুশ শতকে ট্রেন্ডিং। চীনের উত্থানে সবচেয়ে বেশি ব্যাথিত আমেরিকা। বানিজ্য কিংবা সামরিক যেকোন দিক দিয়েই চীনকে ঘায়েল করতে পারলে; আমেরিকা শান্তির পতাকা আকাশে তুলে নাচবে।
ভারতের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক দিন দিন উন্নতির দিকেই। সব মিলিয়ে "চীন ভারত যুদ্ধে" আমেরিকা যে ভারতের পক্ষাবলম্বন করবে তাতে বিন্দু পরিমাণও সন্দেহ থাকার কথা নয়; তবে আমেরিকার এই ভারতপন্থা অবলম্বন যতটা না ভারতের স্বার্থে তার চেয়েও বেশি আমেরিকার নিজ স্বার্থে। আমেরিকা তার নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য "ভারত চীন বৈরিতা" কে প্রভাবিত করার ষড়যন্ত্রও করতে পারে যা উড়িয়ে দেওয়া যায়না। আমেরিকা যে ভারত চীন যুদ্ধকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে চাইবে তার দুটি কারণ হলো-
- একচেটিয়া বানিজ্য করতে চায় আমেরিকা: পুরো পৃথিবী জুড়ে বর্তমানে চীনা অর্থনীতির জয়জয়কার। চীনের বানিজ্যের উপরেই পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের অর্থনীতি নির্ভরশীল। বর্তমানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে চীনের অর্থনীতি কিছুটা কমলেও; দ্রুত সেই ধকল কাটিয়ে উঠে পুনরায় অর্থনীতি সচল করেছে বেইজিং। কোনভাবে চীনাকে স্থবির করে দিতে পারলেই সকল ব্যাবসার আতুড়ঘর হতে পারবে আমেরিকা; এরকম স্ট্র্যাটেজি আমেরিকার থাকাটাই স্বাভাবিক। কোনভাবে ভারত চীন যুদ্ধ লেগে গেলে; চীনাদের অর্থনীতিতে ধ্বস নামবে আর এই সুযোগে আমেরিকাও একচেটিয়া ব্যাবসা করবে দুনিয়া জুড়ে।
- এশিয়াতে মার্কিন প্রভাব বাড়ানো: কিছুদিন আগে তালেবানদের সাথে পরাজয় মেনে নিয়েছে আমেরিকা। মধ্যপ্রাচ্যে ধীরে ধীরে আমেরিকার প্রভাব কমে আসছে। পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কটাও এখন নাই বললেই চলে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন প্রভাব কমেছে বহুগুণ। সবমিলিয়ে এশিয়াতে মার্কিনীদের সুর্য অস্তমিত পর্যায়ে; এমন সময় ভারত চীন দ্বন্দে পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠার একটা সুযোগ তো আছেই। সেই সুযোগ লুফে নিতেই আমেরিকা "ভারত চীন দ্বন্দ্বে" মাথা ঘামাতে প্রস্তুত।
ভারত বনাম চীনের যুদ্ধে আমেরিকা যে ভারতের পক্ষে হয়ে লড়বে তা নিয়ে কারোরোই সন্দেহ নেই। আমেরিকার বানিজ্য ফুলিয়ে ফাপিয়ে তোলার জন্য আমেরিকা ভারতের পক্ষে হয়ে লড়ে যা কিছু করার তার সবটাই করবে। ভারত এক ধাপ এগিয়ে যদি আমেরিকার ফাঁদে পা দিয়ে বসে তবে এশিয়াতে যেকোন সময় ঘোর অন্ধকার নেমে আসতে পারে।
উত্তর কোরিয়া চীনের "তুরুপের তাস"
উত্তর কোরিয়াকে বলা হয় চীনের পালিত পুত্র। উত্তর কোরিয়াকে সামরিক দিক দিয়ে ফুলিয়ে ফাপিয়ে তোলার পেছনে চীনের অবদান অনস্বীকার্য। চীন সাগর পাহারার দায়িত্বে থাকা উত্তর কোরিয়া চীনের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট হিসেবে কার্যকর। ভারত চীন যুদ্ধে আমেরিকার আগ্রাসী মনোভাব ঠেকানোর ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার অবস্থান স্পষ্ট।
যেকোন মুল্যে, আমেরিকাকে চীন সাগর ঘেষা থেকে ফিরিয়ে রাখতে উত্তর কোরিয়া বদ্ধপরিকর। বানিজ্যযুদ্ধের ক্ষেত্রে চীনের তেমন সহায়ক হতে না পারলেও উত্তর কোরিয়া সামরিক দিক দিয়ে চীনের বড় উপকারে লেগে যাবে তাতে বৈকি! চীনের মিত্র হিসেবে উত্তর কোরিয়া খুবই শক্তিশালী পক্ষ। উত্তর কোরিয়াকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে চীনের সুক্ষ্ম দুটি কারণ রয়েছে-
- চীন সাগরে চীনের আধিপত্য ধরে রাখা: চীন সাগরকে আমেরিকার প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার জন্য উত্তর কোরিয়াকে পরিকল্পিতভাবেই এ পর্যায়ে এনেছে চীন। চীন ভারত যুদ্ধের দামামা বাজলে আমেরিকা প্রথমেই চীন সাগর তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইবে। চীন নিজ হাতে এটি সমাধান না করে বরং উত্তর কোরিয়া দিয়েই সেটিকে পর্যদুস্ত করে ফেলবে। ফলে বানিজ্য বাদ দিয়ে কিংবা নিজের দেশ অস্থিতিশীল না করেও চীন সাগরকে আমেরিকার বলয় থেকে মুক্ত করবে; চীন ভারত যুদ্ধের দামামা চললেও অর্থনীতিতে এগিয়ে থাকবে চীন।
- ভালো মানুষীর মুখোশ পড়া: চীন বনাম ভারত; সামরিক শক্তিতে কোন দেশ এগিয়ে? এরকম হিসাব যারা করছেন তাদের এটি মাথায় রাখা উচিত- চীনের সামরিক শক্তির সাথে উত্তর কোরিয়ার শক্তিও যোগ করে দেওয়া উচিত। চীন ভারত যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার প্রভাব কেমন হবে তা প্রায় সবারই জানা। চীনের সাথে যেকোন দেশের সামরিক আগ্রাসন শুরু হলে; উত্তর কোরিয়া দিয়েই মোকাবেলা করে চীন। বিশ্ব জানে উত্তর কোরিয়ার সাথে আমেরিকার শত্রুতা; আসলে শত্রুতাটি ছিল চীনের সাথে আমেরিকার।
আমরা চীনকে যতটা ভাবী তারচেয়েও চীনের পরিকল্পনা অনেক শক্তিশালী। চীনের সাথে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্কটা তেমনি একটি পরিকল্পনার অংশ। ভারত চীন যুদ্ধ শুরু হলে; চীন বানিজ্যে ভারতকে মারার চেষ্টা করবে আর সামরিক দিক দিয়ে উত্তর কোরিয়াকে ব্যাবহার করবে।
ভারত ঘেষা হলেও জাপান থাকবে নীরব
জাপানের সাথে ভারতের সম্পর্ক পুরনো। রাশিয়ার সাথে ভারতের সম্পর্কে চিড় ধরলেও জাপানের সাথে ভারতের সম্পর্ক সবসময় ভালো; কিন্তু জাপানের পররাষ্ট্রনীতি খুবই স্পষ্ট। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর জাপান যুদ্ধের আগ্রাসী মনোভাব থেকে উঠে এসে অর্থনীতিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সাথে সম্পর্ক খুব ভালো হলেও চীন ভারত দ্বন্ধে জাপান নিরপেক্ষ ভূমিকাই অবলম্বন করবে৷ টু শব্দটি করার প্রয়োজনও মনে করবে না জাপান। চীন ভারত যুদ্ধে জাপান কেন নীরব? এর জন্য আমরা দুইটা বিষয়ে আলোকপাত করতে পারি। যেমন-
- ভারতের পক্ষাবলম্বন করে প্রতিবেশীকে ক্ষুব্ধ করবেনা: ভারতের সাথে জাপানের সম্পর্ক ঐতিহাসিক হলেও; চীন জাপানের প্রতিবেশি। বেইজিং মস্কোর দূরত্বের চেয়ে বরং বেইজিং টোকিওর দূরত্ব কম। টোকিও চাইবে না বেইজিং এর সাথে বানিজ্য নিয়ে টানাপোড়েন হোক। জাপানের অনেক কোম্পানি চীনে কাজ করছে। কোন কারণে চীনের সাথে জাপানের টানাপোড়েন শুরু হলে; জাপানের অর্থনীতিতেও ধ্বস নামার সম্ভাবনা বহুগুণ। বর্তমান বানিজ্যনীতির কারণে জাপান কখনোই ভারতমুখী হবে না। ভারতের সাথেও যেহেতু বানিজ্য অনেক; সেহেতু ভারতবিমুখিতাও জাপান হবে না।
- বানিজ্যে উপরে চলে আসা: ভারত চীন যুদ্ধ লাগা মানেই; চীন কিংবা ভারত থেকে বাজার সরে যাওয়া। আর এই সরে যাওয়া বাজার যদি নিজের দেশে নিয়ে যেতে পারে তবে বানিজ্যে নতুন করে আবির্ভাব ঘটবে এশিয়ান এই জায়ান্টের। যদিও জাপান এরকম মনমানসিকতা নিয়ে তেমন একটা আগ্রহী নয়; তবুও জাপান এই সুযোগ হাতছাড়া কখনোই করবেন।
সর্বোপরি, ভারত চীন লড়াই হলে জাপান কোন দিকেই ঝোঁকবে না বরং নীরব থেকে যুদ্ধকে প্রশমিত করার চেষ্টা করবে। ভারতের অর্থিনীতিতে জাপানের ভূমিকা অনস্বীকার্য তেমনি চীনের সাথে জাপানের অর্থনৈতিক সম্পর্কও উন্নত। সবমিলিয়ে; ভারত চীন যুদ্ধ হলে জাপানের গায়েও সে ধাক্কা লাগবে আর এজন্যই অনেকটা নীরব ভূমিকা পালক করবে জাপান।
ইউরোপ নীরব থাকলেও পুর্ব, পুর্ব-এশিয়া চীনের দিকে ঝোকবে:
ইউরোপের দেশগুলো এখন আর আগের মতো যুদ্ধবাজ হিসেবে আচরণ করেনা৷ সবাই বানিজ্যকে গুরুত্ব দিয়ে আগাচ্ছে। বানিজ্যের ক্ষেত্রে চীন কিংবা ভারত উভয় দেশই ইউরোপের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা উভয় দেশেই মানুষের সংখ্যা বিলয়নের উপরে। বিলিয়ন সংখ্যার উপরে মানুষ থাকায় বাজার চাহিদা উভয়ক্ষেত্রেই সমান। ইউরোপীয় দেশগুলো কোন পক্ষাবলম্বন করে বাজার হারাতে চাইবে না। তাছাড়া ইউরোপের বাজারে চীনের আধিপত্য যে নাই তা একেবারেই নয়। বরং এখানে দুটি ফ্যাক্টর বলা যায় ইউরোপের ক্ষেত্রে-
- চীন ইউরোপের সাপ্লাই সোর্স: ইউরোপের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির উৎস চীন। ইউরোপের যেকোন বড় বড় কোম্পানির কাচামাল চীন থেকেই আসে। পোশাক শিল্পের দিক দিয়েও চীন বিশ্বে এক নম্বরে। সব মিলিয়ে চীন ছাড়া ইউরোপ কয়েকদিন টিকে থাকার মতো সামর্থ্য রাখে না৷ সুতরাং চাইলেই ইউরোপ চীনের সাথে বৈরিতা করে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারবে না। জার্মানি, ফ্রান্স কিংবা ইতালি কখনোই এককভাবে কোন দেশের পক্ষাবলম্বন করতে যাবে না৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বানিজ্যনীতি ইউরোপের দেশগুলো মানতে বাধ্য।
- ভারত ইউরোপের প্রধান ক্রেতা: অস্ত্র সামগ্রী থেকে শুরু করে, বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য ইউরোপ থেকে ক্রয় করে ভারত। ইউরোপের প্রধান ক্রেতা ভারত হওয়ায়; চীনের দিকে ঝুকে গেলে ভারতের মার্কেট হারিয়ে ফেলতে পারে ইউরোপ। বিলিয়ন ডলার অর্থনীতির ক্ষতি জেনেশুনে করতে চাইবে না ইউরোপের কোন দেশই।
সবমিলিয়ে ইউরোপ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে। ইউরোপ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলেও দক্ষিন পুর্ব এশিয়া একচেটিয়া চীনপন্থা অবলম্বন করবে। চীনের জন্য এটাই অনেক টার্নিং পয়েন্ট। মায়ানমার থেকে শুরু করে, ভিয়েতনাম কিংবা ইন্দোনেশিয়া প্রায় সকল দেশই চীনের দিকে ঝুঁকে যাবে। এর কারণ হলো- চীনের অর্থনীতি পুর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়ানো। চীন এই বিষয়টি নিয়ে বহুদিন ধরেই এগিয়ে চলেছে।
অস্ট্রেলিয়া যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করবে নিজ স্বার্থেই
অস্ট্রেলিয়ার বর্তমান প্রেসিডেন্ট এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মনোভাব কিছুটা যুদ্ধাপন্থী তবে সামরিক দিক দিয়ে অস্ট্রেলিয়া কখনোই যুদ্ধে জড়ানোর পক্ষপাতী নয়। তবে কয়েক বছর ধরে চলমান অর্থনৈতিক নিম্নমুখীতার কারণে অস্ট্রেলিয়ার বাজার তেমন শক্তিশালী নয়। ভারত চীন লড়াই শুরু হলে; বানিজ্য নিজেদের দিকে নিয়ে যাওয়ার একটি সুযোগ তৈরি হবে অস্ট্রেলিয়ার।
অস্ট্রেলিয়ার সাথে ভারতের সম্পর্ক কিছুটা উষ্ণ হওয়ায় এবং চীনের সাথে অস্ট্রেলিয়ার সম্পর্ক অবনতি হওয়ার কারণে অস্ট্রেলিয়া পুরোদমে ভারতের সাপোর্ট করবে। এদিক থেকে আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক বহু পুরনো সেকারণে ভারতের সাথে অস্ট্রেলিয়া তাল দিয়ে কিছুটা ফায়দা নিতে চাইবে। তবে চীন যেকোন সময় অস্ট্রেলিয়াকে ঘুরিয়ে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে৷ উত্তর কোরিয়াকে ঐ অঞ্চলে লেলিয়ে দিলে জাপান অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকার ঐ অঞ্চল এক নিমিষেই বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে; লাভের চেয়ে ক্ষতির মুখেই বেশি পড়বে ঐ তিন দেশ।
ইসরাইল ভারতের বন্ধুপ্রতীম হলেও পাকিস্তান চীনের ভাই:
ইসরাইল হলো আমেরিকার পালিত পুত্র যেমনটা উত্তর কোরিয়া চীনের৷ ইসরাইলের সাথে ঐতিহাসিকভাবেই ভালো সম্পর্ক রয়েছে ইসরাইলের। অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতের উপকারী না হলেও সামরিক দিক থেকে ইসরাইল হতে পারে ভারতের রেড কার্ড৷ ইসরাইল আমেরিকার কথা ছাড়া একচুলও নড়বে না। সুতরাং আমেরিকা ভারতের পক্ষে থাকা মানে ইসরায়েল ভারতের পক্ষে রয়েছে। তবে ইসরাইলের এই পক্ষাবলম্বন ওতোটা সুবিধের হবে না কারণ ইরানের শত্রু ইসরায়েল; সেক্ষেত্রে ইরানের আশপাশ দিয়ে ইসরাইলের মাতবরি মেনে নিবে না তেহরান। ইরানের সাথে ইন্ডিয়ার ভালো সম্পর্ক হলেও দিনদিন ইন্ডিয়া ইসরায়েল ঘেষা হওয়ায় ভারতের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে ইরান।
এদিকে পাকিস্তানের সাথে চীনের সম্পর্ক অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ। পাকিস্তানের বানিজ্য নিয়ে তেমন পরিকল্পনা নেই; সেহেতু যেকোন সময় ভারতের উপর সামরিক আক্রমণ করার ক্ষমতাও রাখে। ভারতের প্রতিবেশি হওয়ায় পাকিস্তানকে কাছে পাওয়া চীনের জন্য বড় সাফল্য হিসেবেই বিবেচিত। পাকিস্তান চীনকে সমর্থন করার দুটি কারণ হল-
- অর্থনৈতিক করিডোরে পাকিস্তানকে যোগ করেছে চীন: মূলত এখানে অর্থনীতিটাই অনেক বড় ফ্যাক্টর। পাকিস্তান থেকে আমেরিকার চলে যাওয়ার পর থেকে চীন যেভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে তা নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের জন্য বড় সহমর্মিতা। পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতি অনেকটাই সামাল দিচ্ছে চীন। যেকারণে চীনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাতে পাকিস্তান পিছপা হবেনা৷
- ইন্ডিয়ার সাথে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক বৈরিতা: ইন্ডিয়া পাকিস্তান পার্শ্ববর্তী দেশ হলেও এদের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজমান দেশ দুটি জন্মের পর থেকেই। পৃথিবীতে এরকম সাপে নেউলে সম্পর্কে থাকা দেশ আর তৃতীয়টি নেই। সব হিসেব নিকেশ করলে দেখা যাবে; চীন ভারতে আগ্রাসন চালালে পাকিস্তানের অকুন্ঠ সমর্থন পাবে চীন।
এত কিছুর পর এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ইন্ডিয়া চীনের মধ্যে যুদ্ধ কিংবা লড়াই যাই হোক না কেন; মিত্র দেশ বলে এই একুশ শতকে অন্তত কিছু নেই। যে যার স্বার্থের জন্য লড়াই করবে। মূল ক্ষতিটা হবে আমাদের এশিয়াতে। পুরো এশিয়া অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। এশিয়ার অর্থনীতি হুমকির মধ্যে পড়বে। ৪৫০ কোটি অধ্যুষিত এই এশিয়া মহাদেশ যুদ্ধের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। ইন্ডিয়া চীন যুদ্ধ হলে সেটিতে প্রায় অর্ধশত কোটি মানুষ যে না খেয়ে মরবে তা তো আমরা প্রায় সবাই জানি৷ সুতরাং ইন্ডিয়া চীন কিংবা ভারত পাকিস্তানের মধ্যে আমরা যুদ্ধ চাইনা; শান্তি চাই।
আরও পড়ুন>>>
0 মন্তব্যসমূহ