বিএনপি : যে তিন ভুল দলটিকে আলোচনায় নেয়া উচিত

বিএনপি : যে তিন ভুল দলটিকে আলোচনায় নেয়া উচিত

৭ই জানুয়ারি নির্বাচন হয়ে গেল। ভোটার উপস্থিতির শতকরা পরিমান যাইহোক না কেন, ধীরে ধীরে প্রতিটি দেশ ও সংস্থা আওয়ামীলীগ সরকারকে বৈধতা দিচ্ছে যা অনেকটা অনুমেয় ছিল কারণ বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় এটা প্রতীয়মান যে, একটি দেশ নিজ স্বার্থ বা ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন ছাড়া অন্যকোন দেশকে সহযোগিতা করেনা। বিশেষভাবে আমরা দেখতে পেলাম, নির্বাচন পূর্ববর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস যে অবস্থান নিয়েছিলেন, নির্বাচন পরবর্তী পিটার হাস নিজের সেই অবস্থানে নেই৷ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে দৌড়ঝাপ করার পাশাপাশি  আওয়ামীলীগ সরকারের সাথে তার সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা ইতোমধ্যে আমরা বিভিন্ন পত্রিকায় দেখেছি। ভারত, চীন ও রাশিয়া আগে থেকেই  আওয়ামীলীগের প্রতি ধনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি রেখেছিল বিধায় এই দেশত্রয়ের কথা নতুন করে উল্লেখ্য করার বিশেষ প্রয়োজন নেই মনে করি।


তো, নির্বাচন পরবর্তী দেশ রাজনৈতিকভাবে স্বাভাবিকায়নের পর বিএনপির এখন করণীয় কি তা অনেকটাই নির্ধারিত হবে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তার ভুল বুঝতে পেরেছে কি'না তার উপর। বিএনপি কোন ভুল করেনি কিংবা ৭ই জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে মূলত বিএনপিরই বিজয় হয়েছে এসব মন্তব্য বিএনপির নেতাকর্মীরা বললেও রাজনৈতিকভাবে এই বিজয়ের আসলে তেমন কোন মূল্য আছে বলে মনে হয়না কারণ দিনশেষে বাংলাদেশে সরকার হিসেবে  আওয়ামীলীগ পুনরায় ক্ষমতায় এসেছে এবং পৃথিবীর কোন দেশই হাসিনা সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেনি। সুতরাং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিএনপির এক প্রকার পরাজয় যে হয়েছে তা মেনেই বিএনপিকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাজাতে হবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, পক্ষপাতদুষ্ট কোন ব্যাক্তির পরামর্শকে অধিক গুরুত্ব না দিয়ে বরং বিষয়গুলোকে নিরপেক্ষ জায়গায় দাঁড়িয়ে পর্যালোচনা করা উচিত। 


প্রথমত, এই প্রশ্ন জাগে যে, গত ১৫ বছরে বিএনপি জনগণকে সম্পৃক্ত করে এমন কোন আন্দোলন করেছে কি'না যা দেশের মানুষকে আন্দোলনমুখী করবে? দেশে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধি ঘটেছে, দূর্নীতি হয়েছে, গুম-হত্যার মতো নানা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, ব্যাংকিং সেক্টরে দূর্নীতি হয়েছে, শেয়ার বাজারে দূর্নীতি হয়েছে। আরও অসংখ্য জনভোগান্তিমূলক কর্মকান্ড এই দেশে ঘটেছে কিন্তু গত ১৫ বছরে এসব ইস্যুতে বিএনপি মিটিং, মিছিল করেনি কিংবা করার প্রয়োজনও বোধ করেনি। যেহেতু বিএনপিকে এ নিয়ে আন্দোলন করতে বিগত বছরগুলোতে দেখা যায়নি ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে একটি ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, বিএনপি কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই আন্দোলন করে। এটিও সাধারণ জনগণ বিশ্বাস করে যে, বিএনপি ও আওয়ামীলীগ মুদ্রার কেবল এপিঠ ওপিঠ। সুতরাং বিএনপি ক্ষমতায় গেলে চালের দাম কমবে কিংবা দূর্নীতি থাকবে না, এমন নিশ্চয়তা নেই। যেকারণে সাধারণ জনগণ জীবনের ঝুকি নিয়ে রাস্তায় নামতে আগ্রহী হয়না। হ্যা, আওয়ামীলীগের বিগত কর্মকান্ড এবং দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণে বেশিরভাগ জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে আওয়ামী বিরোধী হলেও তারা বিএনপির জন্য রাস্তায় নামবে এমন বিশ্বাস তারা পায়নি। সেই কারনেই ২৮ অক্টোবরের জনসভায় কয়েক লক্ষ মানুষের সমাগম হলেও পরেরদিন আন্দোলনে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসেনি। 


দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি কিংবা বহির্বিশ্বের বর্তমান পলিসি বিএনপি হয়তো ঠিকঠাক বুঝতে পারেনি যার কারণে বিএনপি অতিমাত্রায় বিগত বছরগুলোতে বিদেশনির্ভর হয়ে পরেছিল। প্রথমেই আপনাকে বুঝতে হবে, ইউরোপ কিংবা জাপানের মতো কোন দেশ বর্তমানে অন্যকোন দেশের রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে নাক গলাতে আগ্রহী নয়। তবে এটা সত্য আমেরিকা যেখানে নাক গলাবে সেখানে ইউরোপ তার পূর্ণ সমর্থন অব্যাহত রাখবে অর্থাৎ ইউরোপকে আমেরিকার চোখেই দেখতে হবে তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বর্তমানে এর ব্যাতিক্রম ঘটছে। তবে যাইহোক, এছাড়া ইউরোপের আর তেমন কোন কাজ নেই। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীত মেরুতে রাশিয়া এবং চীন একাট্টা হয়ে কথা বলবেই। বাকি রইল পার্শ্ববর্তী ভারত। আওয়ামীলীগের পাশে যেকোন পরিস্থিতিতে ভারত থাকবে এটা অনুমেয় কারণ ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সালের অভিজ্ঞতা ভারতের জন্য সুখকর ছিল না, এটি যেমন সোনিয়া গান্ধী জানেন তেমনি নরেন্দ্র মোদীও জানেন। সুতরাং ভারত আওয়ামীলীগ তথা শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি পূর্ন সমর্থন দিবে এটাই যুক্তিযুক্ত। এখন, আপনি যতই অস্বীকার করেন যে, আমেরিকা এখন আর ভারতের চোখে বাংলাদেশকে দেখে না কিন্তু বাস্তবতা ওটাই। আমেরিকা বাংলাদেশকে ভারতের চোখেই দেখে আর বিএনপি এতটুকু বুঝতেই ভুল করেছে। সুতরাং আমেরিকার রাষ্ট্রদূত যতই দৌড়ঝাপ করুক এটা অনুমেয় ছিল যে, এই অঞ্চলে ভারত তলে তলে আমেরিকাকে স্বাভাবিকরণের যা করা দরকার তার সবটাই করবে। ফলস্রুতিতে পিটার হাস ভারত যাওয়ার পর পুনরায় বাংলাদেশে এসে নির্বাচন প্রসঙ্গে তেমন কথা বলেন নি। এছাড়াও বিশ্বমঞ্চে শেখ হাসিনার প্রতি বিশ্বনেতাদের একটি পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গী আওয়ামীলীগকে সুবিধা দিয়েছে বলেই মনে করি। সবকিছু বিবেচনায় বলা যায় বিএনপির বিদেশ নির্ভরতা একরকম ভেস্তে যাবে সেটিও অনুমিত ছিল এবং এটি বিএনপিকে বুঝতে হবে যে, প্রেস কনফারেন্সে আমেরিকা যত কথাই বলুক না কেন আমেরিকা তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ছাড়া কিছুই করবে না। বিএনপিকে এটাও বুঝতে হবে যে, আমেরিকার সিদ্ধান্ত প্রেস কনফারেন্স থেকে হয়না। 


তৃতীয়ত, বিএনপির রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে সাধারণ জনগণের মনে সুস্পষ্ট ধারণা নেই অর্থাৎ দলটির প্রধান নেতা কে? তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। নামকাওয়াস্তে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া হলেও রাজনৈতিক সকল সিদ্ধান্ত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান নিয়ে থাকেন এটাই এখন পর্যন্ত সর্বজনস্বীকৃত। দলের সর্বোচ্চ দুটি পদ ভারপ্রাপ্ত থাকায় একটি দলের দূর্বলতাই ফোটে উঠে বলে মনে করি। এছাড়া সর্বোচ্চ পদদারী ব্যাক্তি যিনি লন্ডনে থাকেন তার কথায় বিএনপির নেতাকর্মী ব্যাতিত একটি দেশের সাধারণ জনগণ সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে নামবে তা ভাবা সমীচীন হবে না। পাশাপাশি তারেক রহমান সম্পর্কে দেশের কতিপয় সচেতন নাগরিকের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে এমনকি বিএনপির মধ্যেও এমন ধারণা রয়েছে যে, তারেক রহমানের কারণেই বিএনপি বহির্বিশ্বে ইমেজ সংকটে রয়েছে। এই সংকট উত্তোরণে বিএনপি কতটা কাজ করেছে কিংবা তারেক রহমান নিজে এটি উপলব্ধি করতে পেরেছেন কি'না এটি একটি প্রশ্ন থেকে যায়।


উপরোক্ত তিনটি বিষয়ের পাশাপাশি, জনগণকে বিএনপির স্পষ্ট ধারণা দেওয়া উচিত যে, আওয়ামীলীগের যেকারণগুলোর জন্য জনগণ অসন্তুষ্ট সেই কারণগুলো বিএনপি নিবারণে বদ্ধপরিকর। আওয়ামীলীগের ভিশন থেকে বিএনপির ভিশন যে উন্নতর সেটি না জানাতে পারলে সাধারণ জনগণ কেন বিএনপিকে বিশ্বাস করবে? আওয়ামীলীগ যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে তার বিকল্প কি করা যেতে পারে; কেন করা যেতে পারে ইত্যাদির স্বপ্ন মানুষকে দেখাতে না পারলে মানুষ দিনশেষে এটাই বলবে যে, আওয়ামীলীগ অন্তত: এটা করেছে; বিএনপি তো তাও পারেনি। বিএনপিকে এটাও বুঝতে হবে, বিভিন্ন সোশ্যাল প্লাটফর্মের জনসম্পৃক্ততা দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবেনা বরং গঠনমূলক সিদ্ধান্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বাইরে থেকেই নিতে হবে। মুদ্দাকথা, বিএনপি যদি আন্দোলনে সফল হতে চায় তবে আগামী কয়েক বছর জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচির পাশাপাশি জনগণকে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে, কেন বিএনপিকে মানুষ আওয়ামীলীগের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিবে এবং অবশ্যই একটি সুস্পষ্ট ভিশন মানুষকে দিতে হবে যেন মানুষ বিশ্বাস করে, আওয়ামীলীগের চেয়ে বিএনপি উত্তম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ