মাজহাব ও আহলে হাদিস বিতর্কের চূড়ান্ত ও শেষ সমাধান : মাজহাব মানা ফরজ কি না?

মাজহাব ও আহলে হাদিস বিতর্কের চূড়ান্ত ও শেষ সমাধান : মাজহাব মানা ফরজ কি না?

মুসলিমদের মধ্যে ভাতৃত্ব বজায় রাখা ফরজ। নামাজে হাত বাধা সুন্নাত। সুন্নাত নিয়ে তর্ক করে ভাতৃত্ব নষ্ট করা নিঃসন্দেহে আল্লাহ অপছন্দ করেন।

বাংলাদেশে মাজহাব এবং আহলে হাদিস নিয়ে বিতর্ক চরম পর্যায়ে। বিতর্কের কারণে ফেতনায় পড়ে অনেকেই ধর্ম পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছেন। আহলে হাদিস এবং মাযহাবীদের মধ্যে যে বিতর্ক চলছে সেটি কখনোই কাম্য নয়। যারা ইসলামকে ভালোবাসেন; তারা এরকম বিতর্ক চান না। আজকে আমরা সেই বিতর্কের অবসান ঘটাবো ইনশাআল্লাহ। মাজহাব এবং আহলে হাদিস নিয়ে সমস্ত প্রশ্ন, সন্দেহ কিংবা কাঁদা ছুড়াছুঁড়ি বন্ধ হবে আজই। মনযোগ দিয়ে পড়তে থাকুন।


www.dhakastaff.com


ইসলামপ্রিয় মানুষ হিসেবে প্রায় সকলেরই প্রশ্ন জাগে; মাজহাব এবং আহলে হাদিসদের মধ্যে কোনটি সঠিক পথ? মাজহাব অনুসরণ করবো কি করবো না; এ নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় ভোগেন৷ সবেচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটির সম্মুখীন আমরা হই সেটি হলো- মাজহাব মানা কি ফরজ? আজকে প্রায় সকল প্রশ্নের সুরাহা হবে। আশাকরি, আজকের পর থেকে মাজহাব কিংবা আহলে হাদীস নিয়ে আপনাদের আর কোন সমস্যা থাকবে না।

আহলে হাদিস কারা

আহলে হাদিস শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো- হাদিস বিশারদ। হাদিস বিশারদ তাদেরকেই বলা হয়; যারা হাদিস সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান রাখেন৷ যারা প্রচুর সংখ্যায় হাদিস মুখস্থ করেছেন এবং হাদিসের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ খুব ভালো বুঝেন তাদেরকেই আহলে হাদিস বলা হয়।

বাংলাদেশে আহলে হাদিস বলতে সাধারণত "হাদিসের লোক" কিংবা "হাদিসের অনুসারী"কে বুঝানো হয়৷ আভিধানিক বা প্রায়োগিক অর্থ যাই হোক না কেন- বাংলাদেশে একদল গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় আছে; যারা নিজেরা "হাদিস ও কোরআন" ছাড়া অন্য কাউকে মানেন না বলে দাবি করেন, তাদেরকেই মূলতঃ আহলে হাদিস বলা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে আহলে হাদিসদের নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আহলে হাদিসের সংখ্যা বাংলাদেশে নেহায়েত কম নয়। "আহলে হাদিস আন্দোলন" নামক সংগঠনও আছে তাদের৷ আহলে হাদিস নিয়ে বাংলাদেশে বিতর্ক কেন সেটি জানার আগে; আহলে হাদিসের আকিদা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

আহলে হাদিসের আকিদা

যেকোন ইসলামিক দল বা গোত্রেরই নির্দিষ্ট কিছু আকিদা থাকে। আহলে হাদিসেরও এরকম দু'টি নির্দিষ্ট আকিদা রয়েছে। আকিদা বলতে সাধারণত বিশ্বাস বা মূল ভিত্তি বলা হয়। আহলে হাদিস যে দুটি আকিদা অনুসরণ করে সেটি নিয়ে কারোরই সংশয় বা সন্দেহ নেই বরং ইসলামী অন্য যেকোন গোত্রের ক্ষেত্রেও একই ধরনের আকিদা রয়েছে তবে শিয়ারা ব্যাতিত। আহলে হাদিসের মূল আকিদা দুটি হলো-

  • হাদিস: ইসলামের প্রাণপুরুষ হযরত মোহাম্মদ (সা) এর কর্ম, মৌন সমর্থন এবং সাহাবীদের কর্মকান্ডকে হাদীস বলা হয়। হাদিসের মধ্যে কিছু হাদীস রয়েছে যেগুলো সহীহ বা সর্বোচ্চ বিশুদ্ধ; আবার কিছু আছে যেগুলো দালিলিক দিক থেকে কিছুটা দূর্বল বা যয়ীফ। আবার অনেক ক্ষেত্রে জাল হাদিসও পাওয়া যায়।
  • কোরআন: হযরত মোহাম্মদ (সা) এর উপর অবতীর্ণ আল্লাহর বাণীকে একত্রে কোরআন বলা হয়। কোরআন ইসলামের মৌলিক স্তম্ব। ইসলামকে মানতে হলে কোরআনের কোন বিকল্প নেই।



উপরোক্ত আকিদাদ্বয়ের উপরই আহলে হাদিসরা নির্ভর করেন। এক্ষেত্রে হাদিসের ব্যাপারে কেবল সহীহ হাদিসগুলোই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন এবং আহলে হাদিসরা একরকম হাদিসের ব্যাপারে কট্টরপন্থা অবলম্বন করেন।

মাজহাব কি

মাজহাব শব্দের অর্থ মাধ্যম বা পন্থা। যে পন্থায় হাদিস এবং কোরআনকে অনুসরণ করা হয় সে পন্থাকেই মাজহাব বলা হয়। হযরত মোহাম্মদ (সা) থেকে বর্ণিত লক্ষ লক্ষ হাদিস এবং পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াত; যেগুলো একজন সাধারণ মানুষ ব্যাখ্যা করতে পারেনা সেগুলো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের জন্য যে মাধ্যম গ্রহণ করা হয় সেটি ই হলো মাজহাব।

বাংলাদেশে অনেক অশিক্ষিত মানুষ আছেন; যারা হাদিস কিংবা কোরআন তেমন কিছুই জানেন না৷ পৃথিবীতে এরকম কোরআন হাদিস না জানা অসংখ্য মানুষ আছেন৷ যারা হাদিস কিংবা কোরআন কিছুই জানেন না; তারা কি করবেন? তাদেরকে নিশ্চয়ই কোন না ব্যাক্তিকে অনুসরণ করতে হয় হাদিস কিংবা কোরআন জানার জন্য। কোন ব্যাক্তিকে অনুসরণ করে হাদিস কিংবা কোরআন সম্পর্কে এই  জানার পদ্ধতিকেই বলা হয় মাজহাব।

বাংলাদেশে মাযহাবীদের ব্যাপারে আহলে হাদিসরা নানা রকম বিষোদগার করেন। এই বিষোদগারের মাত্রা এত বেশি যে; এর কারণে অনেক অঞ্চলে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। আমরা আজকে এসব বিষোদগার অবসান করবো ইনশাআল্লাহ। ব্লগটি পড়তে থাকুন।

মাজহাব কয়টি ও কি কি

হযরত মোহাম্মদ (সা) এর ইন্তেকালের পর অনেকগুলো মাজহাবের আবির্ভাব ঘটেছে তবে পৃথিবী জুড়ে কেবল চারটি মাজহাব টিকে গেছে; বাকিগুলো টিকেনি। এই চারটি মাজহাব টিকে যাওয়ার পেছনে রয়েছে; হাদিস ও কোরআনের বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণ। যে ৪টি মাজহাব প্রসিদ্ধতা অর্জন করেছেন সেগুলো হলো-

  • হানাফি মাজহাব: এটি ইমাম আজম আবু হানিফা (র) এর মাসআলা ও হাদিস মূল্যায়নের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। ইমাম আবু হানিফা (র) একাধারে মুহাদ্দিস এবং ফকীহ ছিলেন৷ ইমাম আবু হানিফার জন্ম ৮০ হিজরি ইরাকের কুফা নগরীতে এবং মৃত্যু ১৫০ হিজরি। ইমাম আবু হানিফা সরাসরি তাবেয়ীনদের সাক্ষাৎ পেয়েছেন৷
  • শাফেয়ী মাজহাব: ইমাম শাফেয়ী (র) কোরআন ও হাদিসকে যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তার উপর ভিত্তি করেই শাফেয়ী মাজহাবের উৎপত্তি হয়েছে। ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আবু হানিফা কর্তৃক প্রভাবিত হয়েছিলেন; অর্থাৎ ইমাম আবু হানিফার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ গ্রহণ করে ইসলামের ওপর পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।
  • হাম্বলি মাজহাব: ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বল (র) দ্বারা কোরআন ও হাদীস যেভাবে বিচার বিশ্লেষণ করা হয়েছিল তার উপর ভিত্তি করে হাম্বলি মাজহাবের উৎপত্তি হয়েছিল৷ ইমাম হাম্বলি, ইমাম শাফেয়ী (র) এর ছাত্র ছিলেন; সুতরাং ইমাম হাম্বলি হানিফার সরাসরি ছাত্র না হলেও হানিফা (র) এর ছাত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন৷
  • মালেকি মাজহাব: ইমাম মালেক (র) ছিলেন ইমাম আবু হানিফার সরাসরি ছাত্র৷ ইমাম মালেক (র) এর কোরআন ও হাদীসের বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে মালেকি মাজহাবের উৎপত্তি।

উপরোক্ত চার মাজহাব ছাড়াও যুগে যুগে আরও বহু মাজহাব এসেছিল কিন্তু সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ হিসেবে উপরোক্ত ৪টি মাজহাব  পৃথিবীতে বহুল সমাদৃত এবং বর্তমানে এই ৪টি মাজহাব ই প্রচলিত রয়েছে।

বিশ্বে ৯০% মুসলমান উপরোক্ত চারটি মাজহাবের যেকোন একটি মাজহাবের অনুসারী। বাকি ১০% এর মধ্যে শিয়া, কাদিয়ানি, আহলে হাদিস এবং অন্যান্য রয়েছে।

উপরোক্ত চারটি মাজহাবকে একত্রে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাত বলা হয়। যারা চার মাজহাবের যেকোন একটি মাজহাবকে অনুসরণ করেন তাদেরকে "সুন্নি" বলা হয়। স্কুল কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় বর্ণের জায়গায় "সুন্নি" লিখে অনেকেই৷ এই সুন্নির অর্থই হলো- ব্যাক্তি যেকোন মাজহাবের অনুসারী।

মাজহাবীদের আকিদা কি

মাজহাব মূলতঃ দু'টি আকিদার উপর নির্ভরশীল। আহলে হাদিস যে দু'টি আকিদার উপর বিশ্বাসী; মাজহাবও একই আকিদার উপর ভর করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ আকিদা দু'টি হলো- পবিত্র কোরআন এবং হাদিস শরীফ। এছাড়াও আরও দুটি বিষয়ে মাজহাব গুরুত্বারোপ করে থাকে যেমন-

  • ইজমা: হযরত মোহাম্মদ (সা) ইন্তেকালের পর সাহাবীরা বিভিন্ন সময়ে যেসকল বিষয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে ফতোয়া দিয়েছেন; সে বিষয়গুলোকে বলা হয় ইজমা। হযরত মোহাম্মদ (সা) ইন্তেকালের পর  নতুন কোন বিষয়ে (যে বিষয়ে রাসুল থেকে বর্ণনা করা হয়নি)  ফতোয়া দেওয়ার প্রয়োজন হলে; সাহাবীগণ একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত দিতেন৷ কোরআন হাদিসের পর ইজমাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
  • কিয়াস: যেসকল বিষয় কোরআন বা হাদিসে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই এমনকি সাহাবীগনও ইজমা করেন নি; সে বিষয়গুলোকে কোরআন হাদিসের আলোকে যুক্তিসঙ্গত সমাধান দেওয়াই হলো কিয়াস। কিয়াস দিতে পারেন কেবল তারাই যারা কোরআন এবং হাদিস বিশারদ৷ একজন সাধারণ মানুষের অর্থাৎ যে ব্যাক্তি কোরআন ও হাদিস সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখে না তার কিয়াস সামগ্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

সুতরাং বুঝা গেল; কোরআন এবং হাদিসের পাশাপাশি ইজমা ও কিয়াসেরও গুরুত্ব রয়েছে তবে পরবর্তী দুটি আকিদা অবশ্যই কোরআন এবং হাদিসের আলোকে হতে হবে৷ বর্তমানে অনেক বিষয় ই আছে যেগুলো সম্পর্কে কোরআন হাদিসে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই; সেক্ষেত্রে ইজমা কিয়াসের বিকল্প নেই।

আহলে হাদিস ও মাজহাবীদের মধ্যে বিরোধ কোথায়

আহলে হাদিস ও মাজহাবীদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিরোধ লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশে যেহেতু হানাফি মাজহাবের আধিক্য বেশি; সেহেতু এখানে আহলে হাদিসের সাথে হানাফিদের মতবিরোধ বেশি পরিলক্ষিত। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যই পালনীয় বিষয়গুলোকে বলা হয়; ফরজ এবং ওয়াজিব৷ ইসলামের ফরজ এবং ওয়াজিব নিয়ে হানাফি ও আহলে হাদিসদের মধ্যে তেমন কোন বিরোধ নেই। বিরোধ কেবলমাত্র সুন্নাত এবং নফল নিয়ে; যেগুলো পালন করা অতি অত্যাবশ্যক নয়।

সুন্নাতের মধ্যে কিছু সুন্নত আছে যেগুলো "সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ" অর্থাৎ এসকল সুন্নাত পালন না করলে গুনাহ হবে। সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এর ব্যাপারেও তেমন মতবিরোধ দেখা যায় না; যেসকল সুন্নাত নিয়ে মতবিরোধ দেখা যায় সেগুলো অনেকটাই "সুন্নাতে গাইরে মুয়াক্কাদাহ" অর্থাৎ সেগুলো পালনে তেমন বাধ্যবাধকতা নাই। কেউ যদি সুন্নাতে গাইরে মুয়াক্কাদাহ পালন না করে তবে সেক্ষেত্রে কোন রকম গুনাহ হবেনা৷

এছাড়াও আহলে হাদিসের বেশিরভাগ অনুসারীরা মাজহাব অনুসরণ করাকে বেদাত বলে মনে করেন এবং এটিকে নাজায়েজ হিসেবেও ফতুয়া দেন৷ আহলে হাদিসগণ ধারণা করেন যে- পবিত্র কোরআন এবং হাদিস শরীফ থাকতে কেন মাজহাব অনুসরণ করতে হবে। আমরা ধীরে ধীরে আহলে হাদিস ও মাজহাবীদের বিরোধ নিয়ে কথা বলবো। ইনশাআল্লাহ ব্লগটি পড়ার পর সকল মতবিরোধ থেকে বের হতে পারবেন।

মাজহাব মানা কি ফরজ?

ফরজ শব্দের আভিধানিক অর্থ অত্যাবশকীয় অর্থাৎ যার কোন বিকল্প নাই। ইসলামে ফরজ শব্দটির প্রায়োগিক অর্থ মূলত আরও ব্যাপক যেমন- নামাজ ফরজ; এক্ষেত্রে কেউ যদি বলে নামাজ ফরজ নয় তাহলে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে ঐ ব্যাক্তি কাফের হয়ে যাবেন৷

"মাজহাব ফরজ" এই কথাটির ক্ষেত্রে ফরজ শব্দটি আভিধানিক অর্থে ব্যাবহার করা হয়ে থাকে অর্থাৎ মাজহাবের বিকল্প নেই। যেমন, শিক্ষিত হতে চাইলে স্কুলে যাওয়া ফরজ এখানে ফরজ মানে অত্যাবশকীয় বা যার কোন বিকল্প নেই। এখানে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে স্কুলে যাওয়া ফরজ বলা হয়নি। কেউ যদি বলে স্কুলে যাওয়া ফরজ নয়; তার মানে সে কাফের নয়।

মাজহাব অত্যাবশকীয় কি না; এটা জানতে হলে আমাদের কিছু সাধারণ জ্ঞানের প্রয়োগ করতে হবে। ধরুন, আপনি বাংলা ইংরেজি রিডিং পড়তে পারেন। এখন কেউ যদি অনার্সের বইগুলো দিয়ে বলে এগুলো নিজে নিজে পড়ে পাশ করো; আপনি কি পারবেন? ওস্তাদ কিংবা শিক্ষক ছাড়া আপনি শুধু বই পড়ে পরীক্ষায় পাশ করতে পারবেন? পারবেন না। আর পাশ করতে পারলেও বই সম্পর্কে আপনার অজানা থেকে যাবে বেশি অথবা ভুল জানার পরিমাণও হবে অত্যাধিক।

মাজহাব ব্যপারটিও ঠিক একই রকম। কেবল অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন কোন ব্যাক্তিকে কোরআন এবং হাদিসের গ্রন্থ দিলে সে নিজে নিজে পড়ে সেগুলো বুঝতে কিংবা অনুধাবন করতে পারবে না৷ বিভিন্ন হাদিসের গ্রন্থে বিশ লক্ষাধিক হাদিস রয়েছে৷ একজন সাধারণ ব্যাক্তির পক্ষে নিঃসন্দেহে এতগুলো হাদিস বুঝা সম্ভব নয়। পবিত্র কোরআন শরীফ বুঝতে গেলেও; প্রতিটা আয়াতের শানে নযুল জানা আবশ্যক অর্থাৎ আয়াত নাজিলের প্রেক্ষাপট জানতে হবে। একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে এত কিছু করা কি সম্ভব?
নিঃসন্দেহে নয়৷ আর এজন্যই কোন বিষয়ে ইসলামিক সিদ্ধান্ত পেতে চাইলে; যে ব্যাক্তি কোরআন এবং হাদিস নিয়ে গবেষণা করেছে তার কাছে যেতে হবে। মাজহাব বিষয়টি ঠিক এটাই। ইমাম আবু হানিফা (র) কিংবা শাফেয়ী (র) এর মত ইসলামিক স্কলার্সরা হাদিস এবং কোরআন নিয়ে বিশদ গবেষণা করেছেন। তাদের গবেষণা দিয়েই বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে৷ ব্যাপারটি এমন না যে; সিদ্ধান্তগুলো এসব ইমামদের ব্যাক্তিগত বরং কোরআন ও হাদিসের আলোকেই তারা সিদ্ধান্তগুলো দিয়েছেন৷

আহলে হাদিসের অনুসারীরা মনে করেন- মাজহাবীরা কোরআন হাদিস বাদ দিয়ে ইমামদের অনুসরণ করছেন৷ এটি যুক্তিসংগত কথা নয়৷ একজন ব্যাক্তি যখন নামাজ শিখে; সে কিন্তু কোরআন হাদিস দেখে নামাজ শিখে না৷ মসজিদের ইমাম কিংবা বড়দের দেখে দেখে নামাজ শিখে৷ এর মানে এই নয় যে; কোরআন হাদিস বাদ দিয়ে লোকটি ইমাম বা বড়দের অনুসরণ করছে৷ আর লোকটি ইমামের অনুসরণ করলেও; ইমাম যা শিখান তা কিন্তু কোরআন হাদিসের বাইরে নয়৷

যারা মাজহাব অনুসরণ করেন (পৃথিবীর ৯০ শতাংশ মুসলিম); তারা প্রত্যেকেই বড় চার ইমামকে অনুসরণ করছেন এটির অর্থ হলো; কোরআন এবং হাদিসকে বুঝার জন্য ঐ চার ইমাম গবেষণা করে মুসলিম উম্মাহর জন্য সহজ করে দিয়েছেন; সেই সহজ অর্থগুলোই মুসলিম উম্মাহ পালন করছেন৷ সুতরাং মাজহাবের অনুসারীরা ইমামকে অনুসরণ করছে না বরং কোরআন ও হাদিসকেই অনুসরণ করছে৷

প্রতিটি মাজহাবে বড় বড় মুহাদ্দিস এবং ফকিহগণের আগমণ ঘটেছে৷ যেসকল বিষয়ে চার ইমামের মতামত দূর্বল ছিল; সেগুলো গত ১৪০০ বছরে এসব বড় বড় ফকিহ ও মুহাদ্দিসগণ সহীহ হাদিসের আলোকে আপডেট করেছেন।

উপরোক্ত চার ইমাম ছাড়াও আরও বহুসংখ্যক ইমাম, মুহাদ্দিস, ফকিহর আগমণ ঘটেছিল। তারাও কোরআন ও হাদিসের আলোকে ইসলামকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সবদিক বিবেচনায়; নির্ভুল এবং বিশুদ্ধ হিসেবে উপরোক্ত চারটি মাজহাব গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

যারা মাজহাব অনুসরণ করাকে বাঁকা চোখে দেখেন; তারাও কোন না কোন মাজহাব অনুসরণ করেন৷ আহলে হাদিসের অনুসারীরা সকলেই মুহাদ্দিস ও ফকিহ নন। ইসলামিক কোন মাসআলা সমাধানে আহলে হাদিসপন্থী ওলামাদের প্রয়োজন পড়ে। যেমন; কোন বিষয়ে মাসআলা প্রয়োজন হলে তারা নাসিরুদ্দিন আলবানী (র) এর ফতুয়া অবলম্বন করেন। এক্ষেত্রে তারা নাসিরুদ্দিন আলবানি মাজহাব অনুসরণ করছেন। বাংলাদেশেও আহলে হাদিসের কিছু শায়েখ রয়েছেন যেমন; আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ, ডা. মুসলেমউদ্দীন প্রমুখ এবং আরও অনেকেই। আহলে হাদিসগণ ফতোয়ার ব্যাপারে নাসিরুদ্দিন আলবানীকে যেমন অনুসরণ করছেন; ঠিক তদ্রুপ মাজহাবপন্থীরাও বিভিন্ন ইমামকে অনুসরণ করছেন। এক্ষেত্রে একে অপরকে দোষাদোষীর তেমন যুক্তিকতা নেই।

হানাফি ও আহলে হাদিসের বিরোধ নিষ্পত্তি

পূর্বেই বলা হয়েছে, আহলে হাদিস ও মাজহাবপন্থিদের মধ্যে ফরজ ও ওয়াজিব নিয়ে কোন বিতর্ক বা মতপার্থক্য নেই। সুন্নাত ও নফল নিয়ে কিছুক্ষেত্রে মতপার্থক্য দেখা যায় তবে সেগুলো আহামরি বিষয় নয়। আহলে হাদিসের চিন্তাধারা হলো; সহীহ হাদিসের বাইরে সবকিছুই বিদাত। আসলে এটি ঠিক নয় যে সহীহ হাদিসের বাইরে আমল করা বেদাত বরং সহীহ হাদিসের উপর আমল করা উত্তম। দূর্বল হাদিসের উপর আমল করলেও সওয়াব হবে তবে সেক্ষেত্রে সহীহ হাদিসের মতো সর্বোত্তম হবে না৷ জাল বা মিথ্যা হাদিসের উপর আমল করা বিদাত।

একই আমলের উপর একাধিক সহীহ হাদিস বিদ্যমান। যেকোন হাদিসের উপর আমল করাই সহীহ ও সঠিক। একটিকে গ্রহণ করে অন্যগুলোকে বেদাত বলা নিশ্চয়ই গর্হিত কাজ।
যেমন; নামাজে হাত বাধা কিংবা সূরা ফাতিহার পর আমীন বলা নিয়ে আহলে হাদিস ও হানাফিদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। হানাফি মাজহাব অনুসারে তাকবীরে তাহরিমা বাধার পর হাত নাভির নিচে বাধা হয় আর আহলে হাদিসরা হাত বাধেন বুকের উপর। হাত বাধার ক্ষেত্রে যেসকল হাদিস পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে বুকের উপর, নাভীর নিচে কিংবা পেটের উপরে সকল হাদিস ই সহীহ। যেকোন জায়গায় হাত বাধা জায়েজ। এক্ষেত্রে আপনি আপনার ইচ্ছামতো যেকোন হাদিস অনুসরণ করতে পারেন। তদ্রুপ আমীন জোড়ে কিংবা আস্তে বলা দুটোই সহীহ। আপনি যেকোন একটিকে অনুসরণ করতে পারেন।

মনে রাখতে হবে, এক সহীহ হাদীস পালন করতে গিয়ে অন্য সহীহ হাদিসকে অস্বীকার করা অন্যায়। আপনি যে হাদীস অনুসরণ করেন কেবল সেটি ই সঠিক; অন্যগুলো যারা পালন করে সেগুলো বেদাত এরকম ধারণা পোষণ করা মোটেও উচিত নয়। এতে ইসলামের ভাতৃত্ব নষ্ট হয়। আর ইসলামে ভাতৃত্ব বজায় রাখা ফরজ। সুন্নাত রাখতে গিয়ে ফরজের খেলাফকারীর বিচার আল্লাহই করবেন।

হানাফি ও আহলে হাদিসদের করণীয়

আহলে হাদিস ও মাজহাব তথা হানাফিদের করণীয় হবে; ইসলাম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা। ইসলামকে আল্লাহ সুবহানাওয়া তা'লা সহজ করে দিয়েছেন, ভেদাভেদ ভুলে ভাতৃত্ব বজায় রাখতে আদেশ করেছেন৷ সুতরাং এমন কোন কাজ করা যাবে না যার জন্য ইসলামের ভাতৃত্ব নষ্ট হয়। এক্ষেত্রে মাজহাবী ও লা মাজহাবীদের করণীয় হবে-

যে এলাকায় যে সুন্নাত চালু আছে সেটি অনুসরণ করা। কোন অঞ্চলে যদি বুকের উপর হাত বাধা প্রচলিত থাকে তবে সেখানে হানাফিরাও বুকের উপর হাত বাধবেন। আবার কোন অঞ্চলে যদি নাভীর নিচে হাত বাধা প্রচলিত থাকে তবে আহলে হাদিসগণও নাভীর নিচে হাত বাধবেন। এটাই উত্তম সমাধান কারণ হাত বাধার ক্ষেত্রে উভয় প্রকার হাদিস ই সহীহ।

আমাদের চতুর্দিকে ফেতনায় ভরে যাচ্ছে এক্ষেত্রে ভাতৃত্ব নষ্ট হলে ইসলামের ই ক্ষতি হবে। আহলে হাদিস কিংবা মাজহাবীদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে গেলে সেখানে ফেতনাবাজরা জায়গা করে নিবে ফলে ধর্মীয়ভাবে ইসলামের অবক্ষয় ঘটবে যা কখনোই কাম্য নয়। আমাদের করণীয় হবে; ভাতৃত্ব বজায় রাখা এবং সুন্নাত নিয়ে মতবিরোধ না করে মতবিনিময় করা৷ ইসলামে ইখতেলাফ একটি সৌন্দর্য এটিকে ভাতৃত্ব নষ্ট করার জন্য ব্যাবহার করা উচিত নয়। আজ থেকে শপথ নিন; আহলে হাদিস বিতর্ক নিয়ে ভাতৃত্ব নষ্ট করবেন না বরং যার যে সুন্নাত পালন করতে ভালো লাগে তিনি সে সুন্নাত পালন করুন৷

ব্লগটির মালিকানাস্বত্ব
Dhaka Staff
ওয়েবসাইট: www.dhakastaff.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

14 মন্তব্যসমূহ

  1. আহলে হাদিস ও মাজহাবীদের নিয়ে এত সুন্দর লেখা এই প্রথম পড়লাম। জাযাকাল্লাহ খায়ের। ইসলামের সবাই এক কাতারে চলে আসুক। আমীন।

    উত্তরমুছুন
  2. আহলে হাদিস ও মাজহাবীদের মধ্যে ভাতৃত্ব তৈরী হোক। আমীন।

    উত্তরমুছুন
  3. Ak e bisoi a 2 ta masala thakle jeta strong seta e mante hobe according to actual islam.i am hanafi also.but sohih hanafi

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. Hmmm strong ta manai বুদ্ধিমানের কাজ কিন্তু তাই বলে কেউ অন্যটা মানলে ঝোগ্রা করা লাগবে এমনটা নয়
      আমিও হানাফী কিন্তু সহিহ হানাফী অন্ধ তাকলীদ করিনা আমি

      মুছুন
  4. ড.খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর ও অন্যান্য কিছু আলেম ছাড়া এই প্রথমবার এত সুন্দর লেখা পড়লাম মনে হয় যেখানো আহলে হাদীসদের প্রতি বিদ্বেষ ভাব পোষণ করা হয় নি।

    উত্তরমুছুন
  5. অনেক সুন্দর পোস্ট। আমার খুব ভালো লাগলো

    উত্তরমুছুন
  6. ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ, ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহর ছাত্র!! এরকম ভুল তথ্য দিতে গায়ে বাধে না? নির্জলা মিথ্যা বলে গেলেন!!
    আর্টিকেল লেখার আগে তো পড়াশোনা করে নেওয়া উচিত। এই ধরণের মূর্খতা কাম্য নয়।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. khawarijomi er likhito kitab masanidul imam abi hanifa 31-39 prista porjonto mutala kore dekhin .okhane lekha ase imam malik rh. imam abu hanifar chatro howar bapare

      মুছুন
  7. মাজহাব ফরজ কোন বিষয় নয় কারন (র:) এটার নির্দেশ দেননি..
    মুসলিম হিসেবে যেটা সঠিক সেটা মানাটাই ঠিক আর ইমাম আবু হানিফা নিঃসন্দেহে জ্ঞানী মানুষ ছিলেন তিনি কোরআন হাদীস বোঝানোর জন্যই কিন্ত মাজহাব প্রতিষ্ঠা করেছেন...কিন্ত এই মাজহাব মানতে গিয়ে এবং পর্যন্ত জ্ঞানের অভাবে মুসলিমরা ছোট ছোট বিষয়ে ফাসাদ করছে..
    একটা কথা মাথায় রাখা উচিত সত্য কিন্ত সত্যিই সেটা চাপা থাকবে না কখনো আর... এটাও জানা উচিত ইমাম আবু হানিফা কোন ভুল করেনি বা করতেই পারেন না এমন ধারনা রাখাটা বোকামি..এখন আর তৎকালীন এর মধ্যে পার্থক্য আছে..তখন জানার আর বোঝার জন্য মাইলের পর মাইল দূরে পাড়ি দিতে হতো...
    কিন্ত বর্তমান সময়ে সব চাইতে বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা সমাজের কিছু বড় বেদাত কে নিয়ম হিসেবে সৃকৃতী দিচ্ছি আর সঠিক টা জানার পরেও মানছি না এইটা দোহাই দিয়ে যে আবু হানিফা ভুল করতেই পারে না আর সেই সব জানতা আর বর্তমান জ্ঞানী আলেম রা সবাই গাধা
    সমাজ যে ভাবে চলছে চলবে ভুল হোক আর ঠিক

    শেষে বলবো
    রাসুল (সা:) এর অনুসারী
    কোন ইমামের না
    আর আল্লাহ জানার জন্য জ্ঞান অর্জনের কথা বলেছেন আপনি জানবেন না আবার বিতর্ক করবেন কেমষ বোকামি

    উত্তরমুছুন
  8. আমাদের চতুর্দিকে ফেতনায় ভরে যাচ্ছে এক্ষেত্রে ভাতৃত্ব নষ্ট হলে ইসলামের ই ক্ষতি হবে। সুষ্ট সমাধান তুলে ধরারজন্য ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  9. অল্প আমলই নাযাতের জন্য যথেষ্ঠ অতএব, কোরআন ও হাদিসের বাহিরে কোন কাজ চলবে না। আল্লাহ ইসলাম ধর্ম পূর্ণ করে দিয়েছেন। মানুষের নতুন কিছু মিলানোর অনুমতি নাই।

    উত্তরমুছুন