জর্জ ফ্লয়েড : মাত্র বিশ ডলারের জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিল যে হতভাগ্যকে

জর্জ ফ্লয়েড : মাত্র বিশ ডলারের জন্য প্রাণ দিতে হয়েছিল যে হতভাগ্যকে

২৫শে মে, সোমবার, সন্ধ্যা।

যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের মেনিয়াপলিসের কাপ ফুডস নামক একটি রেস্তোরাঁ থেকে ৯১১-এ একটি ফোন আসল। ফোনটি করেছিল ঐ রেস্তোঁরারই এক ওয়েটার। সে জানায় জর্জ ফ্লয়েড নামক এক ব্যাক্তি তাদের রেস্তোরাঁ থেকে সিগারেট কিনে বিশ ডলারের একটি নোট দিয়েছেন- যেটি জাল মুদ্রা। সে এও জানায় যে লোকটি বেশ মাতাল অবস্থায় আছে।



কিছুক্ষণ পর এক পুলিশের গাড়ি আসে যেখানে ছিল টমাস লেন এবং জো আলেকজান্ডার কুয়েং। লেন এসইউভি'তে বসা ফ্লয়েডকে পিস্তল দেখিয়ে হাত হুইলে রাখতে বলে। তারপর দেড় মিনিট পর পিস্তল নামিয়ে তাকে গাড়ি থেকে টেনে হিচড়ে নামিয়ে রেস্তঁরার দেয়ালে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় জিজ্ঞাসা বাদের জন্য। ৬ মিনিট পর পুলিশের গাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় ফ্লয়েড তার ক্লাস্ট্রফোবিয়ার কথা জানায়।

এ পর্যন্ত পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক ই ছিল। পরবর্তীতে সেখানে উপস্থিত হয় দু'জন পুলিশ সদস্য। ডেরেক শভিন ও টু থাও নামক মানবতাহীন এই পুলিশ দু'জন সেখানে আসার পরই শুরু হয় আসল ঘটনা।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ধারণকৃত ভিডিও এবং আশেপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ অনুযায়ী, পুলিশ অফিসার ডেরেক শভিন গাড়িতে জর্জ ফ্লয়েডের সাথে ধ্বস্তাধস্তি শুরু করে। এসময় পেছনের সিটে ছিল কুয়েং। একপর্যায়ে ফ্লয়েডকে গাড়ি থেকে নামিয়ে রাস্তায় ফুটপাতে উপুড় করে শুয়ানো হয়। পুলিশ সদস্য লেন, শভিন আর কুয়েং জর্জ ফ্লয়েডকে চেপে ধরে রাখে। 

ফ্লয়েড তার মৃত মা আর সন্তানদের জন্যে কাঁদতে শুরু করেন আর বারবার কাকুতি-মিনতি করে শ্বাস নিতে পারছেন না বলে জানান। ৫ মিনিটের মধ্যে মোট ১৬বার "শ্বাস না নিতে" পারার কথা জানায় ফ্লয়েড কিন্তু কোন কাজ হয়নি।

রাস্তায় থাকা লোকজন ফ্লয়েডের এ অবস্থা দেখে প্রতিবাদ করতে শুরু করে বিশেষ করে শভিনকে বারবার সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে কিন্তু শভিন কারোও কথা কানে তোলেনি। এমনকি আরেক অফিসার লেন তাকে দুবার সরে যেতে বললেও শুনেনি। মোট ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড ধরে শভিন ফ্লয়েডকে ঘাড়ে হাটু চাপা দিয়ে রাখেন শভিন।

পুলিশ অফিসাররা প্রথমে রেডিওতে কোড-২ নন ইমার্জেন্সি মেডিকেল টিমের সহায়তা চায় ফ্লয়েডের মুখে আঘাতের কথা বলে। পরবর্তীতে অবশ্য কোড-৩ ইমার্জেন্সি মেডিকেল  টিমের সহায়তা  চায় তারা। তবে অফিসাররা নিজেরা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি এমনকি ফ্লয়েড অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পরও শভিন তাকে এক মিনিট একইভাবে ধরে রেখেছিল। 

বিশ মিনিট পর এম্বুলেন্স এসে সেখানে পৌঁছায়। ইএমটি অফিসার শভিনকে সরিয়ে নিথর ফ্লয়েডের পালস পরীক্ষা করে। এরপর ফ্লয়েডকে এম্বুলেন্সে তোলা হয়। এম্বুলেন্স চলে যাওয়ার পর ইএমটি ফায়ার ডিপার্টমেন্টে ফোন করে সাহায্য চায় কিন্তু ফায়ার ডিপার্টমেন্টের লোকজন এম্বুলেন্সের সঠিক অবস্থান জেনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আরও ৫মিনিট দেরি করে ফেলে কারণ অফিসাররা বলতে পারছিল না এম্বুলেন্স টি কোথায়।

অবশেষে ৯টা ৪৫ মিনিটে হতভাগ্য জর্জ ফ্লয়েডকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তার পোস্টমর্টাম রিপোর্টে জানানো হয়- পুলিশ এর বল প্রয়োগে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু হয়েছে; এছাড়াও জর্জ ফ্লয়েড আগে থেকেই হার্টের অসুখে ভুগছিলেন।

জর্জ ফ্লয়েড গ্রেফতারের পুরোটা সময় ৪জন পুলিশ অফিসারের কর্মকান্ড ছিল সত্যিই প্রশ্নবোধক যেমন, প্রথমে লেন গাড়ি থেকে নেমে পিস্তল উচিয়ে এগিয়ে যায়। সে কেন পিস্তল বের করেছিল তা বোঝা যায়নি। এছাড়াও সবচেয়ে বেশি বিতর্ক জন্ম দিয়েছে যে ব্যাপারটি তা হচ্ছে ডেরেক শভিন ফ্লয়েডের ঘাড়ে হাটু চাপা দিয়ে রেখেছিল যা সুস্পষ্টভাবে আইনবহির্ভূত। 

মেনিয়াপলিস পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পলিসি অনুযায়ী, এ কৌশল  তখনই প্রয়োগ করা যায় যখন কেউ সক্রিয়ভাবে বাধা দেয় অথচ ফ্লয়েড কোনরকম বাধা দেয়নি বরং সে অফিসারদের কথা মতো গাড়িতে বসতে চেয়েছিল। ভিডিওতে আরও দেখা যায়, শভিনকে বারবার গাড়িতে বসার কথা বললেও তিনি একবারও ঘাড় থেকে হাটু সরাননি। ইএমটি এসে উঠতে বলার পর কেবল তখনই তিনি ঘাড় থেকে হাটু সরিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে মুখ মাটিতে চেপে ধরে ঘাড়ে হাটু দিয়ে ভর দিলে সরাসরি বুকে চাপ পড়ে ফলে শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়া মুশকিল হয়ে যায়। বেশিরভাগেরই ধারণা, জর্জের মৃত্যু হয়েছে একারণেই। পুলিশি হেফাজতে জর্জ ফ্লয়েডের এমন মৃত্যুতে ক্ষোভে উত্তাল হয় ওঠে মেনিয়াপলিস শহর। শহরের লোকজন রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে থাকে।

এদিকে ঘটনার সময় ধারণ করা ভিডিওগুলো অনলাইনে ভাইরাল হয়ে যাওয়ার কারণে আস্তে আস্তে প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ গোটা আমেরিকাতে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ জনতা শহরের বিখ্যাত নাবিক ক্রিস্টফার কলম্বাস এবং কনফেডারেট জেনারেলদের মুর্তি ভাঙচুর করে এছাড়াও ব্রিস্টল শহরে ভাঙা হয় এডওয়ার্ড কলস্টোনের মুর্তি। পাশাপাশি আন্দোলনকারীরা দাবি জানায়, আমেরিকার যেসব সেনানিবাসের নাম "কনফেডারেট জেনারেল"দের নামে রাখা হয়ছে তা পরিবর্তন করতে হবে, তাদের মুর্তি জাদুঘরে সরিয়ে ফেলতে হবে।

এর মূল কারণ ছিল, গৃহযুদ্ধের সময় কনফেডারেট জেনারেলরা বর্ণবাদ ও দাস প্রথার সমর্থনে লড়েছিল। স্কুল কলেজের পাঠ্যবইগুলোতে ক্রিস্টফার কলম্বাস এবং উইলিয়াম কলস্টনের মতো দাস ব্যবসায়ীদের গুণকীর্তন বন্ধ করাসহ তাদের মুর্তি সরিয়ে ফেলার দাবী উঠে বিক্ষোভকারীদের পক্ষ থেকে।

জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর সাথে জড়িত ৪ পুলিশ অফিসারকে পরবর্তীতে বরখাস্ত ও গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে শভিনের বিরুদ্ধে মার্ডার আর ম্যান স্লটারের অভিযোগ আনা হয়। এর আগেও ডেরেক শভিনের বিরুদ্ধে গোলাগুলি আর আরেক অফিসার টু থাওয়ের বিরুদ্ধে একজনকে আছড়ে ফেলে পেটানোর অভিযোগ আনা হয়েছিল।

আব্রাহাম লিংকনের দেশ আমেরিকায় "বর্ণবাদ" বহু আগে থেকেই একটি স্পর্শকাতর ইস্যু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। দেশটিতে এর আগেও এই ইস্যুতে বহু মানুষ খুনের ঘটনা ঘটেছে। সত্য কথা বলতে গেলে, এই জঘন্য মতবাদ বিলুপ করার ব্যাপারে দেশটির তেমন কোন আগ্রহ কখনোই লক্ষ্য করা যায়নি ফলে কৃষ্ণাঙ্গরা অহরহ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। বিশেষকরে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে এধরনের ঘটনা যেন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সুসভ্য এই দেশের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে রক্তপ্রবাহের মতো কিভাবে বর্ণবাদ ছড়িয়ে পড়েছে তা যেন আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু।


তাহিয়া
ইকোনমি ডিপার্টমেন্ট, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ