করোনার ভয়াবহ মহামারি চলছে। স্প্যানিশ ফ্লু'র পর এত বড় মহামারি আর কখনোই দেখা যায়নি। চীন থেকে উৎপন্ন হওয়া করোনা ভাইরাসে কাবু পুরো বিশ্ব। এই ভাইরাস থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় করোনা ভাইরাসের যথাযথ ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কার। পুরো বিশ্বের বড় বড় সংস্থা ও বিজ্ঞানীরা একযোগে যার যার যায়গা থেকে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আশাকরা হচ্ছে, এই বছরের সেপ্টেম্বর বা অক্টবরে বিশ্বে "দ্রুততম সময়ে" তৈরি করোনার ভ্যাকসিন উন্মুক্ত হতে পারে এবং সেটি বাজারে আসতে পারে এই বছরেরই ডিসেম্বর নাগাদ৷ পুরো বিশ্ব করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য তাকিয়ে আছে; বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়৷ করোনার ভ্যাকসিন কবে আসবে বাংলাদেশে? যথাসময়ে কি বাংলাদেশ করোনার ভ্যাকসিন পাবে? নাকি বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের জন্য করোনার ভ্যাকসিন পেতে কয়েক বছর লেগে যাবে? এরকম প্রশ্নের উত্তরগুলো জেনে নেওয়া যাক ঢাকা স্টাফের কলাম থেকে।
করোনার ভ্যাকসিন আপডেট
বর্তমানে বিশ্বে শতাধিক প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি, মোটামুটি ১০টির মতো প্রতিষ্ঠান করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। এরমধ্যে আমেরিকার মডার্না এবং যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড সবার আগে রয়েছে।
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ঘোষণা দিয়েছে তারা সেপ্টেম্বরের মধ্যেই করোনার ভ্যাকসিনের নাম উন্মুক্ত করতে চায়। ইতোমধ্যে তারা হিউম্যান ট্রায়ালের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গেছে বলে জানিয়েছে। হিউম্যান ট্রায়ালারের চূড়ান্ত পর্যায় শুরুর দুই থেকে তিন মাসের মধ্যেই করোনার ভ্যাকসিনের নাম উন্মুক্ত হতে পারে যদি হিউম্যান ট্রায়াল সফল হয়।
এদিকে আমেরিকার প্রতিষ্ঠান মডার্না হিউম্যান ট্রায়ালের দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায় সফল হলে তারা চূড়ান্ত পর্যায়ে হিউম্যান ট্রায়াল দিবে। তারপর চূড়ান্ত পর্যায়ে হিউম্যান ট্রায়াল সফল হলে তারাও করোনার ভ্যাকসিনের নাম উন্মুক্ত করবে। মডার্নার অগ্রগতি এবং সফলতা দেখে আশা করা যায়, তারা এই বছরের শেষ নাগাদ করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের নাম ঘোষণা করতে পারবে।
এছাড়াও ভ্যাকসিনের আবিষ্কারে এগিয়ে রয়েছে চীনের কিছু প্রতিষ্ঠানও। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর তারাও হিউম্যান ট্রায়াল শুরু করেছে৷ জার্মানির কিউব্যাকও হিউম্যান ট্রায়াল শুরু করেছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো যারা করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কারে লড়ছে তারা প্রাথমিকভাবে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে রয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশে করোনার ভ্যাকসিন আসবে কবে ও কিভাবে
বাংলাদেশে করোনার ভ্যাকসিন সময়মতো আসবে কি'না এই নিয়ে সংশয় আছে কেননা করোনার মহামারি কেবল বাংলাদেশই মোকাবেলা করছে না বরং বিশ্বের সকল দেশই করোনা মহামারির বিরুদ্ধে লড়ছে। প্রতিটা দেশ তাদের নিজ নিজ জনগণকে বাঁচানোর জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে কোন দেশ বা প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন আবিষ্কার করলে প্রথমেই নিজ দেশের জনগণের জন্য সরবারাহ নিশ্চিত করবে। তারপর অন্যান্য দেশের জন্য তারা ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে।
বাংলাদেশে করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার হচ্ছে না৷ যতদূর জানা যায়; ভ্যাকসিন আবিষ্কারের মতো সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই ফলে করোনা ভ্যাকসিনের জন্য বাংলাদেশকে অন্য দেশের প্রতি চেয়ে থাকতে হচ্ছে এবং হবে।
বাংলাদেশ ১৬কোটি মানুষের অধ্যুষিত একটি দেশ। করোনামুক্ত করতে এদেশে কমপক্ষে ১৫কোটি করোনা ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হবে যা বিশ্বে প্রায় ৮ম। এত বিপুল সংখ্যক ভ্যাকসিন পেতে হলে বাংলাদেশকে প্রচুর অর্থ এবং সময় ঢালতে হবে। তবে ভালো খবর হচ্ছে, ইতোমধ্যে ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটকে ১০০কোটি ভ্যাকসিন তৈরির জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে যেগুলো তুলনামূলকভাবে দ্ররীদ্র এবং অনুন্নত দেশে বন্টন করে দেওয়া হবে৷
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন পাওয়া নিয়ে মূল সমস্যা হলো; চাহিদার বিপরীতে যোগানের ঘাটতি। পৃথিবীকে করোনামুক্ত করতে হলে ৭০০কোটি মানুষের জন্য ৭০০কোটি ভ্যাকসিন বা টিকার প্রয়োজন হবে। এই ৭০০কোটি ভ্যাকসিন প্রস্তুত একক কোন প্রতিষ্ঠানের কয়েক বছর লেগে যেতে পারে অর্থাৎ একক কোন প্রতিষ্টনের পক্ষে করোনার ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা সম্ভব নয়।
আমেরিকার প্রতিষ্ঠান মডার্না ভ্যাকসিন আবিষ্কার করলে তারা প্রথমেই আমেরিকার ৩২কোটি মানুষের জন্য সেটি সরবারাহ করবে; এরপর পৃথিবীর অন্যদেশের চাহিদা তারা পূরণ করবে। তদ্রুপ অক্সফোর্ড প্রথমে যুক্তরাজ্যের যোগান দিবে তারপর বিশ্ব নিয়ে চিন্তা করবে। মডার্না বা অক্সফোর্ড তাদের নিজ দেশের চাহিদা পূরণ করতেই বছর লাগিয়ে দিবে ফলে অন্যান্য দেশ করোনামুক্তিতে পিছিয়ে পড়বে;- মূল সমস্যা এখানেই। বাংলাদেশও এই সমস্যায় পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে তবে এই সমস্যার প্রায় অনেকগুলো সমাধান রয়েছে৷ যেমন-
- ভ্যাকসিনের প্যাটার্ন উন্মুক্ত বা বিক্রি করে দেওয়া: যেহেতু করোনাভাইরাস বিশ্বকে থমকে দিয়েছে সেহেতু এই ভাইরাস থেকে পৃথিবীকে দ্রুতই মুক্ত হতে হবে। সমস্যাটি একক কোন দেশের নয় বরং সমস্যাটি বৈশ্বিক। পৃথিবীকে একযোগে করোনামুক্ত করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভ্যাকসিনের প্যাটার্নটি কিনে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে পারে এতে অনুন্নত দেশগুলো বিশেষকরে; বাংলাদেশের মত দেশগুলো খুব সহজেই ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে পারবে। এছাড়া ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা প্রতিষ্ঠান চাইলে যেকোন ঔষধ প্রস্তুতকারী ফার্মাসিউটিক্যালসের কাছেও তাদের প্যাটার্ণ বিক্রি করতে পারে৷ যেমন: বাংলাদেশের স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, বেক্সিমকোর মত বড় বড় ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে; এরকম ওষুধ কোম্পানি প্রায় কমবেশি প্রতিটা দেশেই রয়েছে৷ এসকল প্রতিষ্ঠানের কাছে প্যাটার্ণ বিক্রি করে দিলে খুব সহজেই বৈশ্বিকভাবে একযোগে করোনামুক্ত হওয়া সম্ভব।
- একাধিক ভ্যাকসিন কার্যকর হওয়া: যদি এমন হয় যে, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে দশটি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাকসিন কার্যকর তাহলে প্যাটার্ণ উন্মুক্তের পরিবর্তেও ভ্যাকসিন পৃথিবীর সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌছে দেওয়া যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে; তুলনামূলকভাবে যেটি সবথেকে বেশি কার্যকর সেটি নিয়ে রাজনীতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
- দাতব্য সংস্থাদের এগিয়ে আসা: করোনার ভ্যাকসিনকে সুষমভাবে বন্টন করার জন্য মেলিন্ডা এন্ড গেটসের মতো দাতব্য সংস্থাগুলো একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। এভাবে যদি বিশ্বের বড় বড় অন্যান্য দাতব্য সংস্থাগুলোও এগিয়ে আসে তবে দ্রারিদ্রপীড়িত দেশগুলোর জন্য ভ্যাকসিন পাওয়া সহজ হয়ে যায়। বর্তমানে বিল গেটস ও তার স্ত্রী মেলিন্ডা গেটসের "মেলিন্ডা এন্ড গেটস ফাউন্ডেশন" অনুন্নত এবং উন্নয়শীল দেশগুলোর জন্য করোনা ভ্যাকসিন প্রাপ্তির জন্য বিশাল বিনিয়োগ করেছে।
মূলতঃ সবথেকে কার্যকরী সমাধান হচ্ছে, ভ্যাকসিনের প্যাটার্ন অবমুক্ত করা বা বিক্রি করে দেওয়া; অবশ্য এর সাথে রাজনীতি এবং আর্থিক বিষয়াদি জড়িত তবুও বিশ্বকে করোনামুক্ত করার জন্য এর বিকল্প আর দ্বিতীয়টি নাই।
ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পেছনে একটি দেশ কিংবা প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেন৷ করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলেও আর্থিক বিষয়টা তাই উপেক্ষা করার অবকাশ নেই।
সবদিক বিবেচনা এটি বোধগম্য যে, ভ্যাকসিন বাজারে আসার কমপক্ষে ৫/৬ মাস পর বাংলাদেশে প্রথম ভ্যাকসিন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। কেন ৬ মাস পর এবং সেটি কিভাবে?
করোনার ভ্যাকসিন বাজারে আসার পর ভ্যাকসিন আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠান ৩/৪ মাসের মধ্যেই তাদের প্যাটার্ণ বিক্রি করা শুরু করবে৷ বাংলাদেশে স্কয়ার কিংবা বেক্সিমকোর মতো প্রতিষ্ঠান সেটি যেকোন মূল্যে ক্রয় করার স্বপ্ন দেখতে পারে অথবা সেটি যদি না হয় সেক্ষেত্রে; ভারতের সেরাম প্রতিষ্ঠানকে ১০০কোটি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানেই বাংলাদেশের জন্য ভ্যাকসিন তৈরী করা হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় দুইশত কোটি ভ্যাকসিনের প্রয়োজন পড়বে যা উক্ত প্রতিষ্ঠানই যোগান দিতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ৬/৭ মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ ভ্যাক্সিন পেয়ে যেতে পারে।
করোনা ভ্যাকসিনের জন্য চুক্তির তাগিদ বাংলাদেশ সরকারকে
এদিকে বাংলাদেশ সরকারকে করোনা ভ্যাকসিনের জন্য আগাম চুক্তির পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অক্সফোর্ডের সাথে কাজ করা এস্ট্রোজেনাকের সাথে আগাম চুক্তি করে ফেলেছে। ইউরোপে ৪০ কোটি ভ্যাকসিনের চাহিদা রয়েছে যা ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত ট্রায়াল সাকসেস হওয়ার সাথে সাথে উৎপাদন করে সরবারাহ করবে এস্ট্রোজেনাক।
বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ যেহেতু ঘনবসতিপূর্ন এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা ভঙ্গুর সেহেতু বাংলাদেশকে দ্রুতই করোনা ভ্যাকসিন পেতে হবে। বিষয়টি খুবই সেন্সিটিভ হওয়ায়, সরকারকে দ্রুত ভ্যাকসিনের জন্য চুক্তি করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তবে এদিকে আশার কথা হচ্ছে, ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দৌড়ে এগিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে "সনাফি" বেশ এগিয়ে রয়েছে। যে দশটি প্রতিষ্ঠান হিউম্যান ট্রায়াল শুরু করেছে তার মধ্যে সনাফি একটি। বাংলাদেশে সনাফির একটি শাখা রয়েছে। টঙ্গী শিল্প এলাকার ঢাকা নরসিংদী মহাসড়কের পাশেই সানাফি এভেন্টাইস নামক ওষুধ কোম্পানিটি অবস্থিত। হিউম্যান ট্রায়ালের চূড়ান্ত পর্যায়ে সফল হলে; বাংলাদেশে করোনা ভ্যাকসিন সরবারাহ করতে পারবে সনাফি।
1 মন্তব্যসমূহ
om অনেক অনেক বেশি ধন্যবাদ স্যার।
উত্তরমুছুন