রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কি : একজন রোহিঙ্গার খোলা চিঠি

রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কি : একজন রোহিঙ্গার খোলা চিঠি

www.dhakastaff.com

আব্দুল মোতালেব। মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা একজন শরণার্থী। ১৭ বছরের এ যুবককে দেখলে মনে হবে, বয়স বুঝি চল্লিশোর্ধ্ব। ঢাকা স্টাফের সাথে কথোপকথনের এক পর্যায়ে সে জানায়, চোখের সামনেই মাকে ধর্ষণ করতে দেখেছে সে। বাবাকে রাইফেলের আঘাতে রক্তাক্ত হতে দেখেছে। শেষ অবধি, সে বেচে গেলেও, যেন ঐ দৃশ্যগুলো প্রতিদিন তাকে বারবার মেরে ফেলে। দুচোখ বেয়ে নিঃশব্দে কান্নার জলগুলো যখন গড়িয়ে পড়ছিল তখন সূর্যাস্তের সময়। লাল সূর্যটা কুতুপালংকে বিদায় জানাচ্ছে, হয়তো সূর্যটা এই কুতুপালং এ আবার ফিরবে কিন্তু মোতালেব জানালো, তার বাবা মা আর কখনোই ফিরবে না।

পৃথিবীর দুর্ভাগা যত ছেলে আছে তাদের মধ্যে মোতালেব একজন। পৃথিবীর মানুষগুলো যখন শিক্ষা, শান্তি, প্রগতির মুহুর্মুহু স্লোগান দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করছে তখন মোতালেবরা নিজেদের পাচটি মৌলিক অধিকারের সবগুলো থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে। 

এসব রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কোথায়? জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গার জীবন ব্যবস্থা কেমন হবে, মৌলিক অধিকারসমূহ তারা পাবে কি না, তা নিয়েই ঢাকা স্টাফের আজকের কলাম। 

রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ:

এক কথায় বলতে গেলে, রোহিঙ্গাদের কোন ভবিষ্যৎ নেই। ভবিষ্যতের সাথে পরিচয় হওয়ার সেই সুযোগও নেই। ভবিষ্যৎ বলতে আমারা সাধারণত একটি মানুষের, সামনের জীবন ব্যবস্থাকে বুঝি যেমন, একটি নির্দিষ্ট সময় পর সে কি করবে, কোথায় থাকবে, কি পড়বে ইত্যাদি সার্বিক ব্যবস্থা ই হচ্ছে একটি মানুষের ভবিষ্যৎ। একটি মানুষ তার ভবিষ্যৎ নিয়ে তখনই বেশি চিন্তা করে যখন মানুষটি শিক্ষিত হয়। যেকারণে পাচটি মৌলিক অধিকারসমূহের মধ্যে শিক্ষা একটি। এই মৌলিক অধিকারটি থেকে রোহিঙ্গারা বঞ্চিত হচ্ছে। সাধারণত শরনার্থী হিসেবে যারা পৃথিবীতে বসবাস করেন তাদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থাকে না। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরনার্থীরাও তাদের ব্যাতিক্রম নয়। কুতুপালং সহ আরও কয়েকটি শরনার্থী ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের ৫ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশুনার সুযোগ করে দিচ্ছে কিছু বিদেশী সংস্থা। এই সংস্থার একজন জানালেন, পর্যায়ক্রমে এসব রোহিঙ্গাদের উচ্চ শিক্ষা নিতে উৎসাহিত করবে এবং সে সুযোগ তারা তৈরী করবেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কি রোহিঙ্গাদের উচ্চ শিক্ষা নিতে সে সুযোগ দিবে?
বাংলাদেশ কখনোই নিরাপত্তা ঝুকিতে পড়তে চাইবে না। দশ লক্ষের অধিক জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তুলা হলে, এক সময় বাংলাদেশ বড় ধরণের বিচ্ছিন্নবাদী আন্দোলনের মুখোমুখি হতে পারে। সেই ভাবনা থেকেই মুলতঃ বাংলাদেশ সরকার রোহিঙাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহনের সুযোগ করে দিবেনা।

নাগরিকত্ব পাবে কিনা:

রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করার পেছনে মিয়ানমারের যে উদ্দ্যেশ্য তাতে করে এটি সহজেই অনুমান করা যায় যে, রোহিঙ্গারা অচিরেই মিয়ানমারের নাগরিকত্ব পাচ্ছেন না কিংবা পেলেও কত যুগ পর পাবেন তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। আন্তর্জাতিক চাপের কাছে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে বাধ্য হবে কি না জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক বিষয়ক গবেষক মাসুদুর রহমান জানান, আন্তর্জাতিক চাপ বলে মিয়ানমারের উপর বস্তুত কিছুই নেই। মিয়ানমারের প্রভু বলে খ্যাত চীন যতদিন না চাইবে, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হোক ততদিন পর্যন্ত মিয়ানমার কখনোই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিবে না। আন্তর্জাতিক বিষয়ক এ গবেষক আরও জানান, বর্তমানে চীনা একটি পরাক্রমশালী শক্তি। পৃথিবীর সমস্ত দেশ যদি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলে তবুও কেবল চীনের কারণেই সেটি সম্ভব নয়।

বর্তমান বিশ্ব কি ভাবছে:

রোহিঙ্গাদের নিয়ে আপাতত বর্তমান বিশ্ব তেমন কিছুই ভাবছে না। জাতিসংঘের বিভিন্ন দাতা সংস্থা তাদের তহবিল থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও তাদের তহবিল থেকে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাসুদুর রহমান জানান, বিশ্বের একটা সহজাত নিয়ম হচ্ছে, যখন যেটি ঘটছে তখন সেটি নিয়ে আলোচনা চলছে। ঘটনার সমাধান হোক বা না হোক, দুইদিন পর বিশ্ব সে ঘটনাটি ভুলে যাচ্ছে। তিনি আরও যোগ করেন, রোহিঙা ইস্যুটি ভুলে যাওয়া একটি ইস্যু। এখন বিশ্ব নতুন নতুন ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত। 

বাংলাদেশ সরকারের করণীয়:

চাইলেও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিতে পারবে না উল্ল্যেখ করে মি. মাসুদ জানান, ব্যাপক এ জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের জন্য একটি ঝুকি। উন্নত দেশ না হওয়ায়, এত বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে সামাল দিতে বাংলাদেশকে সব সময় কঠিন সময় পার করতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত চীনকে যেভাবেই হোক একটা সমাধানে নিয়ে আসা। চীনের সাথে আলোচনায় কুটনৈতিকভাবে সফল হতে না পারলে বাংলাদেশকে এ সমস্যা বহুদিন ভোগ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
শেষে তিনি যোগ করেন যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের চেয়ে চীনের সাথে কুটনৈতিক মিশন বেশি কার্যকর। 


আব্দুল মোতালেবের খোলা চিঠি:

হে বিশ্ব, আমরা পৃথিবীর নিকৃষ্টতম, নিপীড়িত আর নির্যাতিত জাতি। আমার চোখের সামনেই আমার মাকে ধর্ষিত হতে দেখেছি। বাবাকে রাইফেলের আঘাতে রক্তাক্ত হতে দেখেছি। পৃথিবীর একই স্রষ্টা যদি তোমাকে আর আমাকে সৃষ্টি করে থাকে তবে তোমার আর আমার মধ্যে এত পার্থক্য কেন? তোমরা তোমাদের মা বাবার সাথে থাকো আর আমি বিপরীত। 
জবাব আছে তোমাদের কাছে? কেন আমি চোখ বন্ধ করলেই মায়ের চিৎকার করা মুখটা দেখি?
পৃথিবী, তুমি কি আমার হারানো সব ফিরিয়ে দিবে?