বাংলাদেশে অভিনয় জগতের অধিকাংশ অভিনেতা অভিনেত্রীকে শেষ বয়সে এসে সরকারি তহবিল থেকে অনুদান নিতে দেখা যায়। অর্থের অভাবে অনেক অভিনেতা অভিনেত্রী ঠিকমতো চিকিৎসার ব্যয় চালাতে না পারার কারনে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হোন। অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠান আবার অনেকেই লোক লজ্জার ভয়ে তাদের অর্থ সংকটের কথা বলেন না। আত্মীয় কিংবা কোন শুভাকাঙ্ক্ষীর প্রচেষ্টায় তাদের অর্থ সংকটের কথা মিডিয়ায় আসলে জনগণ যেমন তাদের অর্থ সংকটের কথা জানতে পারেন তেমনি সরকারের তহবিল থেকে অনুদানও জুটে।
বাংলাদেশের অভিনয় জগতের সাবেক এসব অভিনয় শিল্পীরা শেষ বয়সে এসে এতটা অর্থ সংকটে কেন পড়েন তা হয়তো অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগায়। অনেকেই এটিকে ইসলামী শরিয়াহ বিরোধী হওয়ায় আল্লাহর শাস্তি হিসেবে উল্ল্যেখ করেন আবার অনেকেই এটিকে শিল্পীদের বেহিসাবি জীবন ব্যবস্থার ফল বলে মনে করেন।
আসলে এসব অর্থ সংকটের পেছনে কারণ কি? কেন চলচ্চিত্রের এসব মানুষরা শেষ বয়সে এতটা অর্থ কষ্টে ভোগেন?
সাধারণত, একজন অভিনয় শিল্পী তার ক্যারিয়ারের শুরুতে প্রচুর অর্থ সম্পদ অর্জন করেন। তার ব্যয়ের পরিমানও তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি থাকে। এভাবে অর্থ উপার্জন আর ব্যয়ের তারতম্যটা কম থাকায় শেষ পর্যন্ত অর্থ সম্পদ ভবিষ্যতের জন্য ধরে রাখা একজন চলচ্চিত্র শিল্পীর জন্য খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও দেখা যায়, বন্ধু বান্ধবীদের বিভিন্ন আবদার থেকে শুরু করে বিভিন্ন মানুষের চাহিদা তারা ক্যারিয়ারের শুরুতে পূরন করেন। মানুষের ধারণা, একজন নায়ক কিংবা অভিনয়শিল্পী প্রচুর অর্থ আয় করেন। এজন্য অধিকাংশ শিল্পীরাই তাদের ক্যারিয়ার শুরু করেন অত্যাধিক ব্যয় দিয়ে।
এভাবে চলতে চলতে দেখা যায়, ভবিষ্যতের জন্য তাদের কোন সঞ্চয় থাকেনা কিংবা চাইলেও তারা সেটি করতে পারেন না।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন নায়ক যখন ত্রিশোর্ধ্ব বা চল্লিশোর্ধ্ব হয়ে পড়েন তখন তার ক্যারিয়ার পড়ে যায়। পরিচালকরা দেখা যায়, নতুন কোন শিল্পীকে যায়গা করে দেন। পুরাতন শিল্পীগুলো একরকম অভিনয় জগৎ থেকে ছিটকে পড়েন। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যেসকল চল্লিশোর্ধ্ব অভিনয়শিল্পী কাজ করছেন তাদের সংখ্যা খুবই কম। এর বেশির ভাগ অংশ কাজহীন হয়ে পড়েছেন, যেগুলোর অধিকাংশ আমরা মনেও করতে পারিনা।
যে অভিনয়শিল্পীগুলো কাজহীন হয়ে পড়েন তাদের বয়স পড়ন্তের দিকে থাকায় নতুন কোন কাজের ক্ষেত্র তারা তৈরি করতে পারেন না। লোক লজ্জার ভয়ে অনেকে কোন কাজের জন্য কারও কাছে আবদারও করতে পারেন না। যেকারনে ব্যাংক ব্যালেন্সে সামান্য টাকাও যদি থাকে তবে ঐ টাকার উপরই তাদের নির্ভর করতে হয়। এভাবে একজন অভিনয়শিল্পী তাদের শেষ জীবনে অর্থ সংকটের দিকে যেতে থাকেন।
এছাড়াও আরও একটি বড় কারণ, আমাদের অভিনয়শিল্পীদের একটি বিরাট অংশ উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে অভ্যস্ত। যেকারণে, আয়করা অর্থের বিরাট একটি অংশ তারা একরকম অপচয় করেন।
শিল্পী সমিতির করনীয়:
শিল্পী সমিতির পক্ষ থেকে একটি ব্যপার সবসময় ভাবা উচিত, যে অভিনয় শিল্পীগুলো তাদের জীবনের চল্লিশটি বছর অভিনয়ের সঙ্গে কাটিয়ে দিল, পরবর্তী সময়ে তার জন্য অভিনয় বাদ দিয়ে অন্য পেশায় যোগ দেওয়া সম্ভব নয়। অনেক দেশে, ৫০ কিংবা ৬০ বছরের বেশি বয়সের অভিনেতারাও নায়কের ভুমিকা পালন করেন অথচ বাংলাদেশে অভিনয়শিল্পীরা ৪০ বছর পার হলে তাকে বাবার অভিনয়ে কাজ করতে হয়। চলচ্চিত্র সমিতিকে এই ব্যাপারটি খতিয়ে দেখা উচিৎ। একজন পরিচালক কেবল অল্প বয়স্ক অভিনেতা দিয়ে নায়কের কাজ করাবেন আবার কেবল মিশা সওদাগরকে দিয়ে হাজার হাজার ছবির ভিলেনের কাজ চালাবেন যা কখনোই কাম্য নয়। এই ব্যাপারগুলোতে সচেতন হতে হবে তাহলেই কেবল একজন শিল্পীকে দ্রারিদ্রতা থেকে বাচানো যাবে।
শিল্পীদের করনীয়:
কেবল শিল্পী নয়, যেকোন মানুষের তার ভবিষ্যত সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিৎ। অল্প করে হলেও ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চয় করে রাখা উচিত। আরও একটা বড় বিষয় হচ্ছে, প্রত্যেক শিল্পীদেরই বিকল্প কিছু করা উচিত যেন, চলচ্চিত্র থেকে বিদায় নিলেও তারা অর্থ সংকটে না পড়েন।
সরকারের করণীয়:
সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কিছু করার না থাকলেও সরকারিভাবে শিল্পীদের সঞ্চয়পত্রের ব্যবস্থা করার তাগিদ দিতে পারেন। এটি হতে পারে ব্যাংকের সঞ্চয়পত্র কিংবা বীমার ন্যায়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই বীমা বা সঞ্চয়পত্র পরিচালিত হলে একজন শিল্পী তার শেষ বয়সের দ্রারিদ্রতা থেকে মুক্তি পাবেন যা ভবিষ্যতে শিল্পী হতে একজন নবীনকে উৎসাহিত করবে।